×

জাতীয়

মিয়ানমারের পরিকল্পিত উসকানি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪৯ এএম

মিয়ানমারের পরিকল্পিত উসকানি

ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আলোচনার দুয়ার বন্ধ করা > সে দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাত আড়াল করার চেষ্টা

মিয়ানমার বেশ কয়েকদিন ধরেই সীমান্তে লাগাতার মর্টার শেল ও গোলা ছুড়ে আসছে। বাংলাদেশের কড়া প্রতিবাদ সত্ত্বেও থামছে না এই উসকানিমূলক তৎপরতা। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। হঠাৎ করে মিয়ানমারের এমন বেপরোয়া আচরণের কারণ পর্যালোচনা করছে সরকার। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে মিয়ানমারের তৎপরতা পরিকল্পিত উসকানি। এর মাধ্যমে তারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। বিশেষ করে সে দেশ থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপড়েন চলছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও অনেকটা গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূরাজনৈতিক নানা উপাদান। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি করে তারা হয়তো প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার দুয়ার দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ রাখতে চায়। তারা হয়তো নিজ দেশে বিরাজমান সংকট আড়াল করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনাকে কাজে লাগাতে ইচ্ছুক। অথবা বাংলাদেশের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো শক্তিশালী দেশের ইঙ্গিতেও এমনটি করে থাকতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিয়ানমার তার ঘনিষ্ঠ পরাশক্তি সম্পন্ন দেশের ইন্ধনে দিনের পর দিন বাংলাদেশ সীমান্তে উপর্যুপরী গুলি ও মর্টার শেল ছুড়ছে। তারা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোচনা ভন্ডুল করতে চায়। প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে তারা উল্টো আরো কিছু রোহিঙ্গাকে এদেশে পাঠানোর সুযোগ খুঁজছে। এ কাজে একাধিক বৈশ্বিক শক্তি তাদের উৎসাহ যোগাচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি এনজিও’র সমর্থনও তারা পাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না। বাংলাদেশ সীমান্তের মিয়ানমারের মর্টার শেল ছোড়ার বিষয়টি প্রয়োজনে জাতিসংঘে উত্থাপন করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করছি। শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমাদের পক্ষ থেকে না হয় জাতিসংঘের কাছে তুলব। আমরা সবকিছু করব। তিনি বলেন, মিয়ানমার কোনো সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখে না। আমরা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সব চেষ্টাই করে যাচ্ছি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমরা চাই, যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আশ্রয় নিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে তারা যেন নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যায়। সে চেষ্টা আমরা করছি। তিনি আরো বলেন, স¤প্রতি আমরা দেখছি মিয়ানমার শুধু রোহিঙ্গা নয়; তাদের অনেক নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ চলছে- থাইল্যান্ড, চীন, মিজোরাম এবং আমাদের সীমানা ধরে। আমরা লক্ষ্য করছি আরাকান আর্মি নামে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সেখানে যুদ্ধ করছে। তাদের সঙ্গে কখনো দেখি ভালো ভাব, কখনো দেখি যুদ্ধ। ভেতরে কি রহস্য সেটা তারাই ভালো জানে। তাদের যুদ্ধ তাদের সীমানায় থাকা উচিত। মন্ত্রী বলেন, আমাদের সীমানায় এসে যে গোলাবারুদ পড়ছে এর প্রতিবাদ আমরা কড়া ভাষায় করছি। তাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা হচ্ছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ডেকে এনে সুস্পষ্টভাবে আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কখনোই যুদ্ধ চান না, আমরা চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান। তাদের যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত- সেটা তাদের সীমানার ভেতরেই থাকুক। তিনি বলেন, মিয়ানমার সীমানার পাশে জিরো লাইনে একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। শুক্রবার সেই ক্যাম্পে গোলাবারুদের আঘাতে একজন মারা গেছে। কয়েকজন আহত হয়েছে। আমরা তীব্রভাবে এর নিন্দা করছি। তাদের এই গোলাবারুদ বন্ধের জন্য আমরা সবসময় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমরা মনে করি তারা ভুল বুঝতে পারবে এবং ভবিষ্যতের সংযত থাকবে। তারা যাতে আর না আসে সেই ব্যবস্থা আমাদের বিজিবি করছে। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেহেতু কিছু লোক এসেছে- তাদের আমরা পুশব্যাক করছি।

এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, রোহিঙ্গারা যে যাবে না, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। যদিও প্রথমে তাদের মানবিক কারণে জায়গা দেয়া হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার মাধ্যমেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। মিয়ানমারে কিছু গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ায় আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা চীন থেকে কিছুটা সরে আসছি। তারপরও আমাদের আমদানিতে চীন-ভারতের ওপর নির্ভরতা আছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের সীমান্তে বার-বার গোলা নিক্ষেপের ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির প্রতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার যে অশ্রদ্ধাশীল তার বহিঃপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির প্রতি মোটেও শ্রদ্ধাশীল নয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার। তারা কূটনৈতিক ভাষা বোঝে না, বা হয়তো বোঝার চেষ্টাও করে না। এমন পরিস্থিতিতে চলমান যে সংকট তারা তৈরি করেছে, সে বিষয়ে বাধা বা প্রতিবাদ করতে গেলে কোন ভাষায় কথা বললে মিয়ানমার শুনবে তা বুঝে সে ভাষাতেই কথা বলতে হবে। গতকাল তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এমন ঘটনার পেছনে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো দুটি বিষয় এখন অনুমেয়। প্রথমত মিয়ানমারের ভেতর যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তা চলার কারণে সে দেশের অখণ্ডতা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অর্থাৎ দেশটি ভেঙে যাওয়ার একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে যদি বৈরী কোনো দেশের সঙ্গে সংঘাত শুরু করা যায়, তাহলে জনগণের দৃষ্টি সেদিকে দিয়ে অখণ্ডতা রক্ষার লড়াইয়ের দিকে জনমত তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয়ত. এ অঞ্চলে বা বিশ্বে কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আর তা হয়েছে এ সরকারের ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। এখন এরকম ঘটনা মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া গেলে আমাদের যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ আরো বলেন, এ সমস্যা সমাধানে যারা উসকানি বা ইন্ধন দিয়েছে তাদের কাছেই আমরা সমাধানের খুঁজে যাচ্ছি। তবে যতদিন না তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু কিছু দেশ আমাদের দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের পথে হাঁটতে বলেছে। যদিও সে পথে হেঁটে কোনো ফল আসেনি। তাই তাদের পরামর্শ উদ্দেশ্যমূলক ছিল কিনা- এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে। আবার পশ্চিমা দেশগুলো বলেছিল, বহুপক্ষীয়ভাবে বিষয়টিকে সমাধান করতে। যদিও এমনটি করতে হলে বিভিন্ন পরাশক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় আছে। আমরা দ্বিপক্ষীয় না বহুপক্ষীয় কিভাবে যাব এখন সেটিও একটি প্রশ্ন। তবে আমি মনে করি দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা দিয়ে যেহেতু হয়নি, বহুপক্ষীয়তা দিয়ে আগামী দিনের সমাধানের পথ তৈরি করা সম্ভব হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, মিয়ানমার যা করছে বিষয়টি আমাদের জন্য দুঃসংবাদ। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত হবে ‘ফরোয়ার্ড ডিপ্লয়মেন্টের’। এ ক্ষেত্রে আমরা সেনাবাহিনীকে সীমান্তের আরো কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি। সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ মহড়াও করা যেতে পারে। এতে তারা বুঝতে পারবে আমরাও প্রস্তুত আছি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায়। জান্তা সরকারের আগ্রাসী মনোভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা বিষয়ে আমরা কোনো সহায়তা পাইনি।

অন্যদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে এখনো থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এতে ফের আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্তবাসী। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গোলাগুলি চলছে। তমব্রু রোহিঙ্গা ক্যাম্প কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। রাত ৮টার দিকে শূন্য রেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে এসে পড়ে তিনটি মর্টার শেল। ক্যাম্পের নিকটবর্তী এলাকায় এসে পড়ে আরো একটি মর্টার শেল। গুলির শব্দে আতঙ্কে আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দরা। তিনি আরো বলেন, কয়েক দিন ধরে চলা গোলাগুলি দুপুরের আগে থেমে যেত, কিন্তু শনিবার দুপুরেও বন্ধ হয়নি। গোলাগুলি শুরু হওয়ায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্রয় শিবিরের কাছাকাছি গোলাগুলি হওয়ায় আতঙ্ক বেশি। তবে আকাশে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়নি। তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা ও ঘুমধুম ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, তিন দিন ধরে সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধ ছিল। শনিবার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে মিয়ানমারে গোলাগুলি হয়। গুলির বিকট শব্দ এপারে আসছে। আতঙ্কে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না এলাকার মানুষ। মর্টার শেলের গোলার বিকট শব্দে কাঁপছে এপারের ভূখণ্ড। এতে এপারের ঘুমধুম ইউনিয়নের ২০ গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু এলাকার কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী কোন সময় গুলি ছুঁড়ে তার ঠিক নেই। তারা গুলি ছুড়লে জবাবদিহি করতে হয় না। তিন দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকায় ঘুমধুমে বেশ কিছু কৃষক চাষাবাদে মাঠে নামলেও শুক্রবার থেকে কেউ নামছে না। সীমান্তে মাইন আতঙ্কে ভুগছেন চাষিরা। তুমব্রু কোনারপাড়ার বাসিন্দা নুর হাসিনা জানান, তার বাড়িতে শুক্রবার রাতে এসে পড়ে একটি মর্টার শেল। কিন্তু সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। তবে, তার বাড়ির কিছু দূরে আরো একটি মর্টার শেল পড়ে বিস্ফোরিত হয়। এই আতঙ্কে তার পুরো পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে তুমব্রু মাঝেরপাড়ায়।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ১৩ আগস্ট থেকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) যুদ্ধ চলছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধ বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ২৭১ কিলোমিটার স্থল ও জলসীমানায় তৎপরতা বাড়াচ্ছে মিয়ানমার। তিন দিন ধরে সেন্ট মার্টিনের বিপরীতে (পূর্ব দিকে) মিয়ানমার জলসীমানায় দেশটির তিনটি নৌবাহিনীর জাহাজ তৎপরতা শুরু করে। তবে সেন্ট মার্টিন জলসীমানাতেও তৎপর আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App