×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ও আমাদের তৎপরতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:১৪ এএম

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এই রোডম্যাপ ঘোষণার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা হলেও চঞ্চলতা তৈরি হয়েছে। বিএনপি ঢাকা শহরের অনধিক ১৬টি স্থানে নিজেদের কর্মসূচি পালনে সক্রিয়তা দেখিয়েছে। আর জাতীয় পার্টির ভেতরে শুরু হয়ে গেছে বহিষ্কারসহ নানা রকমের দ্ব›দ্ব। এসবকে আসন্ন নির্বাচনের অস্পষ্ট লক্ষণ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে বলেই আমাদের মনে হয়। আবার জিএম কাদের ঘোষণা করেছেন, ‘জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সঙ্গে নেই’। বহিষ্কৃত নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা নিজের রক্তের বিনিময়ে হলেও জাতীয় পার্টির ভাঙন রোধের সংকল্প গ্রহণ করে সাংবাদিকদের অবহিত করেছেন। এরশাদ সাহেবের সাবেক স্ত্রী বিদিশার ফাঁস হওয়া একটি অডিও রেকর্ড থেকেও মোটামুটি জানা গেল যে, জিএম কাদের একজন ভদ্রলোক, তার শরীরেও এরশাদের রক্ত প্রবহমান। সুতরাং তার অসম্মান হয় এমন কিছু করা থেকে জনৈকর প্রতি বিদিশার উপদেশ। সেই উপদেশ থেকেই জানা গেল যে, তাদের যে কোনো বিপদ-আপদে জিএম কাদেরই সবার আগে ছুটে আসবেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায়ও জাতীয় পার্টির নানা কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে এসেছে- সেসব কর্মকাণ্ড কখনো কখনো গঠনমূলক থাকলেও বেশিরভাগ সময়েই তা ছিল নিতান্তই মুখরোচক কিচ্ছা! এসব অপ্রকাশিত থাকলেই ভালো ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব রাখঢাক করা সম্ভব হয়নি- সাধারণের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, সাম্প্রতিককালের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ভাইরাল’ হয়েছে। সার্বিকভাবে দলের ভাবমূর্তি বারবার ক্ষুণ্ন হয়েছে। তৃণমূলে দলটির গ্রহণযোগ্যতাও হ্রাস পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এরশাদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জন্য দলকে বিভিন্ন সময়ই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে- ভাবমূর্তি বিনষ্টের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ যাবৎ বর্ণনা থেকে আমরা একটি বিষয় স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি যে, এখনো জাতীয় পার্টির অবস্থান নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান স্পষ্টভাবে অনুমান করার সাধ্যও আমাদের চিন্তার নৈকট্য থেকে অনেক দূরে! তাই সে বিষয়ে সময়ই যথোচিত সত্য উদঘাটন করবে বলে বিষয়টি জাতীয় পার্টির নিয়তি এবং অনাগত সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে আপাতত নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করা যাক। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি কিছুটা সরব হলেও এখনো আমরা দলটির মুখে সেই চির পুরনো দাবির কথাই উচ্চারিত হতে শুনছি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচন করবে না এখন পর্যন্ত এই কথারই পুনরাবৃত্তি শুনছি। একই কারণে তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্বেও অংশগ্রহণ করেনি। উপরন্তু দলটির উচ্চ পর্যায়ের কোনো কোনো নেতার বক্তব্য ‘আমরা এই সরকারকেই মানি না, তার আবার নির্বাচন কমিশন’ বলে তাচ্ছিল্যসহ ব্যঙ্গ করেছে! আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি প্রবণতা এরূপ যে, তারা নির্বাচন কমিশনকে মনে করে বসে থাকে সব সমস্যার সমাধান করনে-ওয়ালা! যেসব সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মীমাংসিত হওয়ার কথা তা না করে অনেকটা যেন নালিশের ভঙ্গিতে নির্বাচন কমিশনের নিকট অবহিত করা। এটা যে এক ধরনের রাজনৈতিক পঙ্গুত্ব তা তারা ভেবেও দেখে না! রাজনীতির এই সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরুতে পারিনি- এটা নিঃসন্দেহে রাজনীতিরই অপারগতা! আবার নির্বাচন কমিশনের কিছু কাজকেও সাধারণ বিবেচনায় আমাদের কাছে আগ-বাড়িয়ে ঘাড় পেতে বোঝা বহনের মতো মনে হয়েছে। এই যে তারা সব দলের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, চা খেলেন, মতবিনিময় করলেন শেষ পর্যন্ত সেই পুরনো প্রবাদের কথাই তো প্রমাণিত হয়েছে ‘যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপ্পান্ন!’ কোনো দলই কি তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছে? নাকি তারাও কোনো দলের ওপর তুষ্ট হতে পেরেছে? উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি না হলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পালাক্রমে এরূপ চা-চক্রের আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণের নজির দেখা যায় না। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার দায় আমরা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলাম। নির্বাচন কমিশনকে নানা স্টেক-হোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখলাম। যদিও এরূপ বৈঠককে বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা যেহেতু সরকারকেই মানে না তাই নির্বাচন কমিশনকেও গুরুত্ব দেয়নি! আমরা মনে করি বিএনপির এই অহেতুক তাচ্ছিল্যের ভাগিদার নির্বাচন কমিশন না হলেও পারত। যে কোনো সংকট নিয়ে আলোচনাই উত্তম পন্থা এসব নীতিকথা শুনতে ভালো লাগলেও সব আলোচনা থেকে সব সময় ভালো ফল যে পাওয়া যায় না তা আবারো প্রমাণ হলো। নির্বাচন কমিশন আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের নিজস্ব বিধিবদ্ধ আইনি কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা করায় যা যা করণীয় সেদিকে মনোনিবেশ করলেই ভালো হতো। সামাজিক এসব আনুষ্ঠানিকতায় সময়ের যেমন অপচয় তেমনি সত্যিকার অর্থে কাজেরও মারাত্মক ক্ষতি। এসবই চূড়ান্ত বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় অপচয় মাত্র! রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য নির্বাচন কমিশন নয়- রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দল বসে নির্বাচন সংক্রান্ত তাদের ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত কমিশনকে অবহিত করলে কমিশন সেইমতো ব্যবস্থা নিলেই মন্দের ভালো একটি ফল হয়তো পাওয়া সম্ভব হতো। সরকারের আজ্ঞাবহ নামক তকমা বিভিন্ন দলের নিকট থেকে নির্বাচন কমিশনকে শেষ পর্যন্ত দেয়া হয় বটে- যা স্বাধীন কমিশনের জন্য দুর্ভাগ্যই বলা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে যেমন চুল পরিমাণ সরেনি, তেমনি বিএনপিও নিজেদের ওই একটি মাত্র দাবির বাইরে এখনো পর্যন্ত কোনো বক্তব্যই প্রদান করেনি! এখন প্রশ্ন হতে পারে বিএনপি তাহলে কী করবে? ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সুবোধ বালকের মতো নির্বাচনে অংশ নেবে নাকি ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণায় জাতীয় জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে! আবার আমাদের দেখতে হবে সর্বত্র জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, খুন, সন্ত্রাস! যদিও বিএনপি বারবার সরকার পতনের আন্দোলনের ওপরই জোর দিয়ে কথা বলছে কিন্তু সেই কথা তৃণমূলকে, এ দেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষকে কতটা প্রভাবিত করছে? বিএনপির এই আহ্বান সাধারণ মানুষকে আদৌ উজ্জীবিত করতে পারছে কিনা তার খোঁজখবরও দলটির নিশ্চিতরূপে জানা নেই। তবে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে হঠাৎ হঠাৎ বিএনপি সচকিত হয়ে ওঠে! কোনো সামাজিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে সেখানে নাক গলিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানেই সাধারণ মানুষ তা বুঝে ফেলে ‘পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে’ বিএনপি তার ফসল ঘরে নিতে চায়! বিএনপির এরূপ হতোদ্যম অবয়ব আমরা বিগত এক যুগে কম দেখিনি! সুতরাং সাধারণ মানুষের কাছে সরকার পতনের মতো বিএনপির আবদার কতটা আন্তরিকভাবে পৌঁছায় সেটা দেখতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন পর্যন্ত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বয়সের বিবেচনায় দলটির চেয়ারপারসন বেগম জিয়া কারগার থেকে বাসায় অবস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মুক্ত নন এ কথাটি সাধারণ মানুষ জানে। আর দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানও সাজাপ্রাপ্ত এবং আইনের ভাষায় একজন পলাতক আসামি। ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকায় দুজনের কেউ নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিতে পারবেন না আপাতত এটিই হচ্ছে বিধি- বিএনপির বিধিলিপিও। সে ক্ষেত্রে দলটির নতুন নেতৃত্বে কে আসবেন এখনো তা পরিষ্কার হয়নি। ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মধ্যে আমরা এখনো যথেষ্ট ঘোলাটে পরিস্থিতি বিদ্যমান দেখি। পরিস্থিতি যতই ঘোলাটে হোক মির্জা ফখরুল সাহেবের তর্জন-গর্জনের শেষ নেই! শেষ নেই এখনো পুরনো ঢঙের রাজনৈতিক অপপ্রচার ও বাহাসের! একদা বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া যেমন বলতেন আওয়ামী লীগের হাতে গেলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি হবে, দিল্লি হয়ে যাবে বাংলাদেশের রাজধানী ইত্যাদি! ইদানীং মির্জা ফখরুলও দেখছি অনুরূপ বক্তব্য প্রদান করে সাধারণকে বিভ্রান্ত করছেন। সাম্প্রতিককালের শেখ হাসিনার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে ফখরুল সাহেব বলতে শুরু করেছেন বাংলাদেশ ভারত হয়ে গেছে! এ ধরনের কথা রাজনৈতিক রিটোরিক হলেও সার্বভৌমত্বের ওপর মারাত্মক আঘাত স্বরূপ বলেই সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের মূল্যায়ন। সম্ভবত বাংলাদেশে ভারতের বাজারকে লক্ষ করে তিনি এরূপ কথা বলে থাকতে পারেন। কিন্তু ভারতের চেয়ে চীনের বাজারও বাংলাদেশে কম নয়। সে ক্ষেত্রে মির্জা সাহেব কখনো বলেন না বাংলাদেশ চীন হয়ে গেছে! মূলত ভারতবিদ্বেষকে পুঁজি করেই বিএনপির জন্ম ও বড় হওয়া! অপরদিকে ফখরুল সাহেবের আরেকটি বক্তব্যও আমাদের সার্বভৌমত্বকে আঘাত করে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল। পাকিস্তানপ্রীতি থাকলেও একটি দলের মহাসচিব পর্যায়ের নেতার মুখ থেকে সাধারণ মানুষ এরূপ বক্তব্য আশা করে না। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এরূপ অপরিচ্ছন্নতা যতদিন থাকবে ততদিন গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যতই চিৎকার-চেঁচামেচি করি না কেন প্রকৃত গণতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না! শালীনতা, শোভনতা, বাস্তবতা রাজনীতিচর্চায় অন্বিষ্ট না থাকলে গণতন্ত্র কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করতে পারে না। কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনেই গণতন্ত্রচর্চা ও গণতন্ত্রের সুরক্ষা হয় না। দেশ ও জনগণের প্রতিও একটি সৌম্য ও সাংস্কৃতিক নিবেদন থাকা চাই। এ কথা কেবল বিএনপি নয়- আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের কাছেই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। মানুষ প্রত্যাশা করে অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচনও। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App