×

সারাদেশ

বাড়ছে ব্যয়, জনদুর্ভোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫২ এএম

বাড়ছে ব্যয়, জনদুর্ভোগ

ফাইল ছবি

সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় ত্রুটি

চট্টগ্রাম নগরীতে যানজট কমাতে ও বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুত করতে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের খরচ ও মেয়াদ দুটিই বাড়ছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুর ৫ বছর পর নকশা পরিবর্তনের জন্য বড় অঙ্কের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। টেকসই সম্ভাব্যতা যাচাই করা ছাড়া প্রকল্পটির কাজ শুরুর পর কয়েক দফায় নকশা পরিবর্তন করাসহ নানাবিধ সংকট তৈরি হয়। এরইমধ্যে এই মেগা প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই পর্যায়ে এসে প্রকল্পটির মেয়াদ এবং ব্যয় দুটোই বাড়ছে। সীমাহীন জনদুর্ভোগ আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর, ট্রাফিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে নকশা প্রণয়ন এবং বারবার নকশা বদল ও সমন্বয়ের অভাবেই মূলত এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্দরকেন্দ্রিক যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেন বিশিষ্ট সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকাটি বঙ্গবন্ধু টানেল, আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দর সড়কসহ একাধিক মেগাপ্রকল্পের সংযোগস্থল। কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে সেখানে কোনো ইউলুপ, ইউটার্ন বা সার্ভিস রোড না থাকায় সুষ্ঠু যানবাহন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম ট্রাফিক বিভাগ। এই প্রকল্পের কারণে এমনিতেই কয়েক বছর ধরে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে নগরবাসী। এ নিয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থা চউকের বিরুদ্ধে ক্ষোভও রয়েছে তাদের। এখন নতুন করে এক্সপ্রেসওয়েটির অ্যালাইনমেন্ট, র‌্যাম্প ও স্প্যানের দৈর্ঘ্যে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব এসেছে। কাজের মেয়াদ বাড়লে সড়কের বিদ্যমান দুর্ভোগও দীর্ঘায়িত হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নকশা সংশোধনের কারণে ব্যয় আরো ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বেড়েছে। আর মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে প্রকল্পটির খরচ ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ও মেয়াদ ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল।

কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি ও বিকল্প সড়ক চালু করতে সময়ক্ষেপণ এবং করোনা মহামারিসহ নানা কারণে প্রকল্পটি দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। গত মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) একনেক সভায় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে ৭ বছর হয়। আর এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে মোট খরচ হবে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।

গত একনেক সভায় এই প্রকল্পটির নকশায় সংশোধনী আনা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের কাছে চউকের পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়, সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় ত্রæটি রয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েটির বর্তমান নকশার ‘অ্যালাইনমেন্ট ঠিক নেই’ বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। জানা গেছে, পুরনো নকশায় কাজ করা হলে র‌্যাম্প, অ্যালাইনমেন্টসহ বেশ কিছু সমস্যা থেকে যাবে, যা প্রকল্পের সুফলের বদলে যানবাহন চলাচল উল্টো জটিলতা তৈরি করবে। পুরনো নকশায় স্প্যানের দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৫ মিটার রাখা হলেও নতুন নকশায় তা বাড়িয়ে ৪৫ থেকে ৫০ মিটার করা হয়েছে। পাশাপাশি ভূমিতে রাস্তার প্রশস্ততা ঠিক রাখতে পিয়ারের পরিসর কমিয়ে নকশায় সংশোধন আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে কংক্রিটের গ্রেডের পরিবর্তনসহ অতিরিক্ত নির্মাণ ব্যয় এবং কিছু অংশের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানো হয়। আগের নকশায় র‌্যাম্পগুলো পিসি গার্ডার দিয়ে তৈরি করার কথা ছিল। নতুন নকশায় তা আরসিসি বক্স গার্ডার দিয়ে তৈরি করা হবে, যাতে চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্পের মাধ্যমে বড় আকারের (লং ভেহিক্যাল) নির্বিঘেœ যাতায়াত করতে পারে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, মূল নকশাটি চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা হয়নি। বিশেষ করে সল্টগোলা থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে যে ধরনের নকশা করা দরকার ছিল, সেভাবে করা হয়নি। যা চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে উক্ত এলাকা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত রাখতে প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। এছাড়া বন্দরের গাড়ি সহজে চলাচলের জন্য যথাযথ ‘ফাউন্ডেশন, সাব স্ট্র্যাকচার ও সুপার স্ট্র্যাকচার’ তৈরি করে নতুন নকশায় অ্যালাইনমেন্ট করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির নকশায় নতুন করে অ্যালাইনমেন্ট, র‌্যাম্প ও স্প্যানের দৈর্ঘ্যে সংশোধন আনা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যানবাহন ওঠানামার জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। এতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে যেসব গাড়ি চলাচল করবে, সেগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারবে। ১৬ কিলোমিটার উড়াল সড়কটি দেওয়ানহাট রেলসেতুর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেঁষে টাইগার পাস মোড়ের পর মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে।

বিশেষায়িত এ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের মাঝপথে এসে এক্সপ্রেসওয়ের নকশা পরিবর্তন, নতুন কম্পোনেন্ট যুক্ত করার বিষয়টি অপরিকল্পিত উদ্যোগের ফল বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, টানেল নির্মাণ কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প শুরুর আগেই এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। চউকের এ ভুলের কারণে প্রকল্পের সুফল পেতে দেরি হওয়ার পাশাপাশি অর্থের অপচয় হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে আউটার রিং রোড ও নগরীর সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনায় বড় ধরনের গলদ আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরুর সময় থেকেই তা বলে আসছি। কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ করেণে সিএমপির পর্যবেক্ষণের পরে এখন নতুন করে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমস্যার সমাধান না করেই তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করায় নানা সমস্যা দেখা দেয়। কাজ চলমান অবস্থায় বিরোধ মেটানো ও অ্যালাইনমেন্ট সংশোধন করতে হয়েছে। এতে দ্বিমুখী ক্ষতি হয়েছে। সঠিক অ্যাসেসমেন্ট করে কাজ শুরু না করায় এবং নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় খরচ বাড়ছে। সময়ও বেশি লাগছে। এতে জনগণের সুফল পেতে যেমন দেরি হচ্ছে, পাশাপাশি ভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, কয়েক দফায় নকশা বদল করতে হয়েছে। এর কারণে হচ্ছে এই প্রকল্পের জন্য সার্বিক কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। একটি ট্রাফিক সমীক্ষা হয়েছিল। এই ফ্লাইওভার করা হলে চট্টগ্রামের যানজট সমস্যার সমাধান হবে কিনা, এমন একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। এই প্রকল্পের জন্য ডিটেইলড ডিজাইন করা হয়নি। যে নকশার মাধ্যমে সয়েল টেস্ট, পাইলিং, পিলারের আকার বা দুই পিলারের মধ্যে কত দূরত্ব এ রকম ডিজাইন করা হয়নি। একটা রাফ নকশা ছিল, চূড়ান্ত কোনো নকশা ছিল না। এছাড়া প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক না হওয়ায় কাজ শুরুর পর সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন নকশা চূড়ান্ত করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন নকশায় এখন ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৬০০ কাঠা। অথচ আগের নকশায় এটা ধরা হয়েছিল ১৩০ কাঠা। ফলে ৫৭ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এছাড়া পিডিবি ও ইউটিলিটি লাইন সরানোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১৮ কোটি টাকা। এখন ধরা হয়েছে ২২০ কোটি টাকা। এসব কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App