×

মুক্তচিন্তা

তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলন না কি আমদানি?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৪৯ এএম

বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের অকস্মাৎ মূল্যবৃদ্ধির সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বিশ্ববাজারে তার মূল্য তীব্র গতিতে কমতে শুরু করে এবং তা বহুলাংশে কমে গেলেও সরকারিভাবে তা মাত্র ৫ টাকা হ্রাস করায় দেশব্যাপী তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একে অনুকম্পা বলে মনে করেন দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। আবার সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রী-নেতারা এই হ্রাসকে একটি ‘দূরদর্শিতার প্রমাণ’ বলে উল্লেখ করে গভীর আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করেছেন। মানুষের মনে বেড়ে চলেছে হতাশা ও ক্ষোভ। কারণ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যপণ্য, কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, আমদানি পণ্য, রপ্তানি পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়েই চলেছে হু হু করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এমন ধাক্কা অতীতে কোনোদিন এ দেশের মানুষকে সইতে হয়নি। পঞ্চাশের মন্বন্তর- যা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ব্যবসায়ীদের অসৎ কারসাজির পরিণতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল শুধু খাদ্যপণ্যের দাম আর তাতেই অবিভক্ত বাংলায় প্রায় এক লাখ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এখন সব ধরনের পণ্যমূল্য বাড়লেও অনাহারে মৃত্যুর খবর নেই বটে, তবে অর্ধাহারে বা একবেলা খেয়ে বহু মানুষ দুঃসহ কষ্টে কায়ক্লেশে বেঁচে আছেন। এমন বাঁচা তো মৃত্যুর সমতুল্যই। এই সংকট সৃষ্টি হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ খুঁজে পাই না। একটি মাত্র কারণ হলো তেল-গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। আমদানিনির্ভরতা কাটানোর চেষ্টা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সময় থাকতে সচেষ্ট না হওয়ার কারণেই মূলত এই সংকট। বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরকারের ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ সংকট দীর্ঘকাল আমাদের ভুগিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা- এমনকি দিনের পর দিন যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের অপ্রতুলতার কারণে মানুষকে গভীর অন্ধকারের মধ্যে বাস করতে হয়েছে- সেই বিএনপি আমলের দৃশ্য আজও মনে পড়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে অসংখ্য ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদেশি সহায়তায় গড়ে তুলে এই সংকটের সমাধান করল বটে, কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ার ফলে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় জনগণের আর এক দুর্ভোগের সৃষ্টি হলো। সে দুর্ভোগ চলছেই বরং তা ক্রমবর্ধমান, কারণ সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে জনমতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। তবে অস্বাভাবিক বিলম্বে হলেও সরকার সম্ভবত শিগগিরই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে যাচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের গত ৩ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় ‘সংকট সামলাতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে তোড়জোড়’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করেছে: ‘দেশে গ্যাসের মজুত দিন দিন কমছে। অন্যদিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রচুর প্রাপ্তির সম্ভাবনাও রয়েছে। এতদিন সেদিকে নজর না দিয়ে জোর দেয়া হয়েছে আমদানিতে। ফলে রাজকোষ থেকে বেরিয়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ- বৈদেশিক মুদ্রায়। বিভিন্ন কারণে হঠাৎ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন থমকে গেছে আমদানি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চাপ পড়েছে জনগণের কাঁধে। জল ঘোলা করে এখন দেশীয় তেল-গ্যাস আহরণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর তোড়জোড় শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরদিন ৪ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ‘দেশীয় জ্বালানি উত্তোলনে গুরুত্ব’ শীর্ষক অপর এক প্রতিবেদন স্থান পেয়েছে আরেকটি জাতীয় দৈনিকে। এতে বলা হয়েছে: ‘বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন করে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতদিন দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বারবার তাগিদ দিলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। এখন বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের চাপে পড়ে টনক নড়েছে নীতি-নির্ধারকদের। জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় খনিজ জ্বালানি উত্তোলনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১০ সালের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের দিকেই ঝুঁকেছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে গ্যাসকূপ খননের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অবস্থান জানতে জরিপ, অনুসন্ধান, উত্তোলন, আমদানি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর ভুল নীতি অনুসরণ করাই বর্তমান সংকটের মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কখনো গ্যাসের ব্যবহার, কখনো কয়লার ব্যবহার, আবার কখনো আমদানি করা গ্যাসের ওপর ভর করে প্রয়োজন মেটানোর নীতি গ্রহণ করা হয়। যখন যে সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের এবং জনগণের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় না রেখে নিজেদের পছন্দের নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাস্টার প্ল্যান নিয়েও তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১০ সালের মাস্টার প্ল্যানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ ভাগ কয়লা থেকে আহরণের মাস্টার প্ল্যান নিলেও তা কার্যকর হয়নি। ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার কথা বলে সরকার কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতির কারণে আবার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য নানা মহল থেকে সরকারকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও এতকাল তা কেউ আমলে নেয়নি। উল্লেখযোগ্য, এলএনজি আমদানির বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বারবার বিরোধিতা করলেও সংশ্লিষ্টরা তা কানে তোলেননি। এখন উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। সোলার এনার্জির প্রতিও গুরুত্ব বাস্তবের চেয়ে কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়নি- যা এখন দেয়া হবে বলে বলা হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, আজকের এই সংকট সরকারের ভুল নীতির কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের তেল-গ্যাস খুঁজে বের করার জন্য জরিপ, অনুসদ্ধান এবং উত্তোলনের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে; কিন্তু সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এগুলোতে কান দেয়নি। দেশীয় তেল-গ্যাস উত্তোলনে সরকারি অনীহা ছিল চোখে পড়ার মতো। অনুসন্ধানে অনীহার কারণে পেট্রোবাংলাকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। পেট্রোবাংলায় বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনবলও নিয়োগ দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেও প্রকাশ্যে পেট্রোবাংলার কার্যক্রম বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অথচ আরো ৫-৬ বছর আগে দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসদ্ধান শুরু হলে এখন হয়তো কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যেত। এখন সংকটে পড়েই সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহি বলেন, ‘বাংলাদেশে অনুসন্ধান হয়নি এ কথা বলা ঠিক না। আমরা দেশের স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করেছি। জ্বালানি সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে আমরা দেশীয় জ্বালানির উৎপাদন বাড়াতে গত ৫ বছরে কয়েকবার নতুন পুরনো কূপ খনন করেছি। গত বছরই আমরা ৪টি কূপ খনন করেছি। বাপেক্সের সহযোগিতা নিয়ে আমরা অনুসন্ধান কাজে মাহপরিকল্পনা নিয়েছি। বাপেক্স ছাড়া অন্য কাউকে অনুসন্ধান কাজ করতে দিচ্ছি না। যদিও ভোলার এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আইওসিকে কাজ দিচ্ছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি না।’ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘সরকারকে স্বল্পমেয়াদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। মূলত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই গ্যাস অনুসন্ধানে যেতে হবে।’ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানিয়েছেন, গ্যাসের অনুসন্ধানে ৪৬টি কূপ খননের মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ভোলার শাহবাজপুরের গ্যাসক্ষেত্রে কাজও শুরু হয়েছে। শ্রীকাইলে একটি রিগ কাজ করছে। এরপর বিয়ানিবাজার ও শরীয়তপুরে খনন কাজ শুরু হবে। পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে গভীর ও অগভীর সমুদ্রের ২৬টি ব্লকের মধ্যে ৪ ও ৯নং ব্লকে ভারতীয় কোম্পানি এএনজিসি কাজ করছে। ২০২০ সালে কনকো, ফিলিপস, ব্রিটিশ পেট্রোবংলায় এক্সিম মোবিলের মতো কোম্পানির সঙ্গেও পেট্রোবাংলা বৈঠক করেছে। এভাবে ইদানীংকালে যে গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন প্রভৃতি কাজ হাতে নেয়া হয়েছে- এতে গ্যাসের সন্ধান কোথাও কোথাও যদি পাওয়া যায়ও তবু তা উত্তোলনে বহু বছর সময় লেগে যাবে। ততদিন জ্বালানি আমদানি ব্যতিরেকে এখন আর কোনো বিকল্প নেই। এহেন পরিস্থিতি সরকারের অবহেলাজনিত কারণেই উদ্ভব ঘটেছে। তাই সরকারের কারা কারা এই অবহেলা ঘটিয়েছেন তার অনুসন্ধান করে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। কারণ তাদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার মাশুল গুনতে হবে জনগণকে দীর্ঘকাল ধরে। মনে পড়ে, বছর কয়েক আগে আন্তর্জাতিক আদালতে দুটি মামলায় বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করেছিল একটিতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে-অপরটিতে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, এই বিজয়ের ফলে বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃীর্ণ তীরবর্তী অঞ্চল ও আইনসম্মতভাবে সাগরের অভ্যন্তরের বিশাল এলাকা বাংলাদেশের মালিকানায় আসবে। আর ওই এলাকাগুলোতে তেল-গ্যাসের যে বিশাল রিজার্ভ আছে বলে জানা যায়, তা উত্তোলনের মাধ্যমে হয়তো তেল-গ্যাসের বাংলাদেশের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব হবে, কলকারখানা অধিকতর সংখ্যায় স্থাপন করে উৎপাদনের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি প্রভৃতির মাধ্যমে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে। প্রশ্ন হলো- তখন থেকেই অনুসন্ধান কাজ তাহলে কেন হাতে নেয়া হলো না। নিলে হয়তো আজ এই সংকটের মুখোমুখি হতে হতো না। যা হোক আর কালবিলম্ব না করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বাজারজাতকরণে ত্বরান্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App