×

মুক্তচিন্তা

ক্রিকেট খেলা ও ঘৃণার টেলিপ্যাথিক প্রভাব

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৩২ এএম

এক সময়ে ক্রিকেট খেলতাম। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত খেলেছি। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম বলব না, তবুও খেলতাম। এ করতে গিয়ে ক্রিকেটের প্রতি এক ধরনের প্রীতি গজিয়ে গেছে। এখন তাই ক্রিকেট খেলা রাত জেগে হলেও দেখি। সব ক’টি খেলা দেখি তা হলফ করে বলতে পারব না, তবে এবারের এশিয়া কাপের বলতে গেলে সব ক’টি খেলা দেখেছি। আমার দেশের সঙ্গে কারো খেলা হলে ত কথাই নেই। আমি সে খেলা দেখি, সে খেলা আমার জন্য স্মৃতি জাগরূক। দেশটা স্বাধীন না হলে একটা আস্ত টিমকে নিয়ে কি আমরা ক্রিকেট মাঠে নামতে পারতাম? পাকিস্তান আমলে সান্ত¡না হিসেবে দ্বাদশ খেলোয়াড়ের ভূমিকায় পূর্ব পাকিস্তানি কাউকে মাঝে মাঝে দেখেছি। সেটাও আবার ৬ দফার তোড়ে। অনেক সময় দ্বাদশ খেলোয়াড়টি থাকত আমার সহপাঠী, পাকিস্তানি কিন্তু ইন্টার উইং স্কলারশিপে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। নামটা ছিল জামিল, তার মুখে গুটি বসন্তের স্পষ্ট দাগ ছিল বলে তাকে স্মরণ করতে পারি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না, বেঁচে আছে কিনা জানি না। আমি বাংলাদেশের খেলা দেখি দেশ প্রেমের কারণে। কখনো যে খেলোয়াড়দের মুণ্ডুপাত করি না, তা নয়। আমাদের খেলোয়াড়দের একটি বৈশিষ্ট্য অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট; তাদের প্রেডিক্ট করা অর্থাৎ তাদের নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা অতি দুষ্কর। তাদের অধিকাংশই মনে হয় ভাগ্যে-দুর্ভাগ্যে বিশ্বাসী। সবাই জানেন এই খেলায় এবারে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান খেলেছে। আমাদের দেশ প্রথম দুটি খেলায় হেরেছে। দ্বিতীয়টি জয়ের সম্ভাবনা ছিল, একটু চালাক-চতুর হলেই হয়ে যেত। দুঃখ পেয়েছি, বকাবকি করেছি। তারপরও তাদের সঙ্গেই আছি। ভাবছিলাম বাকি খেলাগুলো দেখব না। এই ভাবনা থেকে ছিটকে পড়লাম। সিদ্ধান্ত নিলাম অন্তত পাকিস্তানের সঙ্গে যেসব দল খেলবে, সেসবের খেলা দেখব। কারণ অনেকগুলো। পাকিস্তান মাঝেমধ্যে ভারতের সঙ্গে খেলে। ভারত আমাদের পরম মিত্র, সবার কাছে না হলেও আমার কাছে। কারণ ভারতের অন্ন-জল আমার রক্তে ৯ মাস প্রবাহিত ছিল। ১৯৭১ সালে ভারত আমাকে তথা আমাদের আশ্রয় না দিলে, ট্রেনিং না দিলে, অস্ত্র না দিলে এবং শেষকালে যৌথ বাহিনীতে মিত্রের ভূমিকা না নিলে আমাদের দশা কী হতো? আমরা কি তিব্বতীয় কাঞ্ছা হয়ে ভারতে থেকে যেতে বাধ্য হতাম? স্পষ্ট জবাব নেই, তাই কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। বন্ধুত্বের একটা টান প্রায়ই অনুভব করি। পাকিস্তানের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণার আবহ আমার থেকেই যাচ্ছে। ২৩ বছর তারা ধর্মের নামে আমাদের শাসন, শোষণ, নির্যাতন করেছে দেদার। ৯ মাস তাদের সৈনিকরা ইসলাম রক্ষা করার নামে আমাদের মাটিতে গণহত্যা চালিয়েছে, নারী ধর্ষণ করেছে, পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেছে, আমাদের সোনার মানুষদের অকাতরে হত্যা করে দেশটাকে মেধাশূন্য ও নেতাশূন্য করতে চেয়েছিল। তারপরও তারা তাদের অপকর্মের জন্য এতদিন পরও সামান্য অনুতপ্ত হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাদের নিজেদের উদ্যোগেই করা উচিত। তা তারা করেনি। আমাদের সম্পদের হিস্যা দেয়নি। পক্ষান্তরে সুযোগ পেলেই আমাদের অস্তিত্ব মুছে দেয়ার প্রয়াস চালায়। আমি নিশ্চিত আমাদের জাতির পিতার সপরিবারে নৃশংস হত্যার পেছনে তারা দায়ী। এমনকি বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার পেছনেও তারা রয়েছে। তাই তাদের মানুষ হিসেবে নিন্দা জ্ঞাপনটি আমার দায়িত্ব। ক্রিকেট বা অন্য যে কোনো খেলায় আমি তাদের বিপক্ষে থাকি। এবারে আমি একটি ব্যক্তিক্রমী কাজ করে বসি, যা পরে বলছি। এবারে আমি পাকিস্তানের সব ক’টি খেলা দেখেছি। কেননা আমি দেখতে চেয়েছিলাম তথাকথিত ইসলামি রিপাবলিকান পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা মাঠে নামাজ পড়ে কিনা, দ্বিতীয়ত তাদের মহিলা দর্শকদের ক’জন হিজাব পরে খেলা দেখতে আসে। আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যাদের কাছে পাকিস্তান নমস্য, কারণ তারা মুসলমান। একবার নিউমার্কেটে ভারত-পাকিস্তান খেলার সময় আমার সঙ্গে অন্যদের তুমুল বিতর্ক, মারামারি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়। আমি ভারত সমর্থক জেনে তারা আমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলল। শুধু তাই নয়, তারা আমাকে ভারতের দালাল বলতে দ্বিধা করল না। আমি তাদের থামাতে গিয়ে কতগুলো প্রশ্ন করলাম। প্রথম প্রশ্নটি হলো আপনি কেন পাকিস্তানকে পছন্দ করেন? জবাব পেলাম ‘তারা মুসলমান, ভারতীয়রা হলো হিন্দু, এই হিন্দুদের দুর্বল বা নিঃশেষ করে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের পবিত্র দায়িত্ব।’ আমি বললাম ‘আপনি ত মুসলমান হিসেবে এক আল্লাহ বিশ্বাস করেন এবং তাও বিশ্বাস করেন যে আল্লাহই সব মানুষের স্রষ্টা। তারা জবাবে ‘হ্যাঁ’ বললে আমি বললাম যে ‘মুখে আপনারা এক আল্লাহ বিশ্বাসী হলেও অন্তরে কিন্তু একাধিক স্রষ্টার অবস্থান স্বীকার করে নিয়ে কবিরা গুনাহ করেছেন। তাদের চিন্তায় ফেলে দিলাম। আমি অন্য প্রসঙ্গ টানলাম। বললাম ‘মুসলমান হিসেবে আপনারা বিশ্বাস করবেন যে সব মানুষ আদম (আ.) ও বিবি হাওয়ার সন্তান।’ আমার কথা শুনে হ্যাঁ, না বলে তাদের উপায় ছিল না। অনেকটা মুগ্ধ হয়ে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমার অধ্যাপকের পরিচয় ও একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পেয়ে তারা স্বর নামিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করল বা ধর্ষণ করল তাদের ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান। মুসলমান হয়ে মুসলমানকে ধর্ষণ করাটা আপনারা কীভাবে মেনে নিচ্ছেন? একপর্যায়ে তারা বললেন, আমরা হয়তো ভুল নিয়েই থাকতাম, যদি আপনার সাক্ষাৎ না পেতাম। বহুদিন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অতিশয় ভালোবাসা ও সমীহের সম্পর্ক ছিল। অন্তত আমি তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে এই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িটা আমাদের সমূহ ক্ষতি বা ধ্বংসের কারণ হতে পারে। আমি সে ব্যাপারে সংযত কিন্তু নিজের মনকে প্রবোধ দিতে কিংবা ধর্মান্ধদের কাছে তথ্য তুলে দিতে ধর্মাচারী পাকিস্তানিদের আচরণ দেখতে সব ক’টি খেলা দেখছিলাম। দেখলাম তারা মাঠে নেমে নামাজ পড়েননি বা তাদের নারী দর্শকদের মধ্যে কেউ হিজাব পরে মাঠে আসেননি (অবশ্য ফাইনাল খেলায় একজন নারীকে হিজাব পরা অবস্থায় একাধিকবার দেখেছি; তার বেশি কেউ থাকতে পারেন)। ১১ সেপ্টেম্বরের ফাইনাল খেলার বেশ আগে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে দর্শক হিসেবে আমি আমার অবস্থান পরিবর্তন করব। আমি লক্ষ্য করলাম, এবারের খেলায় আমি যে দলকে সমর্থন করেছি, সে দলটিই হেরে গেছে। একটা দুষ্টামি মাথায় চাপল। ভাবলাম আমি এখন থেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করব। যেদিন থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা শুরু করলাম সেদিন পাকিস্তানের খেলা ছিল। প্রথম যে দিন পাকিস্তানের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলাম; তার আগের দিন বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা মাঠে নেমে নামাজ পড়েছিল। বাংলাদেশ হেরেছিল। সেদিন নামাজ না পড়ে মাঠে নামাতে বাংলাদেশে কেউ কেউ ভবিষ্যৎ বাণী করল যে আজকে পাকিস্তান হারবে। কিন্তু না, পাকিস্তান হারেনি। আমি সেদিনও পাকিস্তানের বিপক্ষেই ছিলাম। আগেই বলেছি মাথায় একটি দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল যে আমি যে টিমকে সমর্থন করব, সে টিমই হারবে। ভাবলাম আমি যখন কুফা, তখন পাকিস্তানকে সমর্থন করে দেখি না কী হয়? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, পাকিস্তানের পক্ষ নিলেই পাকিস্তান পরাজিত হবে। পাকিস্তানকে পরাজিত করার আর কোনো বল বা কলা-কৌশল আমার জানা ছিল না। আমি তা ফেসবুকে লিখে কাউকে কাউকে জানিয়েও দিলাম। তারা আমার আচরণে কিছুটা বিরক্ত হলো। বলল ‘আমরা মরে গেলেও পাকিস্তানকে সমর্থন করব না।’ আমি একটি নেতিবাচক আচরণ দিয়ে ইতিবাচক ফল আনব বলেই এমনটি করলাম। আশ্চর্যজনকভাবে আমার সমর্থিত দল পাকিস্তান শ্রীলঙ্কার কাছে পরাজিত হলো। ফাইনাল খেলার দিনই আমি বাংলাদেশের কীর্তিমান খেলোয়াড় মুশফিকুর রহিমের ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমি এখন পাকিস্তানের সমর্থক। কারণটা জানালাম, নিশ্চিত ধরে নিলাম শ্রীলঙ্কাই জিতবে আর পাকিস্তান হারবে। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ফাইনালে শ্রীলঙ্কাই জিতেছে। বুঝলেন, ঘৃণার টেলিপ্যাথিক প্রভাব আছে। আমার কাছে এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App