×

মুক্তচিন্তা

তিস্তার অপ্রাপ্তি থাকলেও শেখ হাসিনার ভারত সফর সফল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৪:৩৭ এএম

চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র। আওয়ামী লীগ মনে করে ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। অপরদিকে ভারতও শেখ হাসিনার শাসনামলের বাংলাদেশকে সুপ্রতিবেশী মনে করে। উপরন্তু ভৌগোলিক কারণে ভারত বাংলাদেশকে কিছুটা বাড়তি গুরুত্বও দেয়- দিতে হয়। আবার দ্বিপক্ষীয় কিছু অমীমাংসিত বিষয়কেও ভারত দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রেখেছে। এর মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন অন্যতম। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিস্তা সংকটের সমাধান হলেই দেশের জনগণ অন্য ১০টি প্রাপ্তির চেয়ে বেশি খুশি হতো। আন্তর্জাতিক নদী আইনে তিস্তার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্যতা থেকে ভারত আমাদের বঞ্চিত রেখেছে। শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না-পাওয়ায় তীব্র খরা আর বর্ষা মৌসুমে বাঁধ খুলে দেয়ায় ভয়াবহ বন্যাকবলিত হয় উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা। ভারতের ‘তিস্তা নীতি’ বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ছোট-বড় ৫৪টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় চতুর্দিক-বেষ্টিত বলে ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যাও বেশি। আবার সমস্যা যতই থাকুক বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত ঐতিহাসিকভাবেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত। জীবনযাপন এবং সংস্কার-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ও ভারতের নৈকট্য শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- রক্তের সম্পর্কেও বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ অটুট ঐক্যে আবদ্ধ। দেশভাগের বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর রক্ত-সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ স্বজনরা এখনো উভয় দেশে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান! ভূরাজনৈতিক সীমান্তরেখা কঠোর হলেও দুই পারের মানুষের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গভীরতর। মানবিকতার সেই বন্ধনের গভীর উচ্ছ¡াস আমরা মাঝেমধ্যে উপলব্ধি করতে পারি। উভয় দেশের মানুষের মধ্যকার ইতিহাসচারী আলোচনায় আন্তরিকতার সেই স্পর্শ অনুভূত হয়। অতীতের সুখস্মৃৃতি নিয়ে উভয় দেশের মানুষই ক্ষণিকের জন্য হলেও পুলক বোধের চেষ্টা করেন। এরূপ ঐতিহ্যিক কারণেই ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঊর্ধ্বে এবং গত এক দশকে তা আরো জোরদার হয়েছে’- বলে মন্তব্য করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আরো বলেছেন, ‘বিগত ৫০ বছরে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার পর, উভয় দেশই ক্রমবর্ধমান বিস্তৃত সেক্টরাল সহযোগিতায় কাজ করছে।’ বাংলাদেশের আরেক সীমান্তের ওপাশেই রয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমারও বাংলাদেশের প্রতিবেশী। প্রতিবেশী হলেও নানা কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে তাদের বহু আচরণ আমাদের আহত করে- যা অপ্রতিবেশীসুলভ! বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মিয়ানমার গোলাগুলি, রকেট হামলাসহ নানা ধরনের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে- তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও আমাদের ভূখণ্ডে তাদের মর্টার শেল এসে পড়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইনকেও অশ্রদ্ধার মাধ্যমে এক ধরনের অহেতুক উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলেছে! ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রæতা নয়’ নীতিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে ধৈর্যসহ প্রতিবেশীসুলভ আচরণই প্রকাশ করে যাচ্ছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক যেমন ভালো থাকে তেমনি ভেতরে ভেতরে নানা রকমের সূ² হিসাব-নিকাশও থাকে, থাকে নানা রকমের টানাপড়েনও। প্রতিবেশীর সঙ্গে সব সময়ই দেনা-পাওনার নানা বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও চলে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের প্রতিটি কার্যকলাপ ও স্বার্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কৌশলী অঙ্কও থাকে। সেই অঙ্কে যে যত বেশি পাকা তার লাভও তত বেশি। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে পৃথিবীর যে কোনো দেশ সফরই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী যখন ভারত সফর করেন তখন সেই সফরের দিকে সূ² নজর থাকে সবার, নজর থাকে তিস্তার ওপর। শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরেও দেশের আপামর মানুষ উৎসুক হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত সফর করেন তখন মানুষের মধ্যে আগ্রহ, উত্তেজনা উৎকর্ণ ও ঔৎসুক্য বেশি পরিমাণে দেখা যায়। কারণ নানাবিধ। একদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শেখ হাসিনা তার সন্তানসহ ৬ বছর ভারতে আশ্রিত ছিলেন। অপরদিকে জন্মের আঁতুড় ঘর থেকেই বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে! এটি শুধু অভিযোগ হলেও মন্দ ছিল না- এটি একটি অতিকায় ‘ভয়’ও! বিএনপি দেশের মানুষকে এই ভয় দেখিয়েই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল- যাকে বলে ক্ষমতাকে ‘ভোগ’ করেছিল। গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রসঙ্গ নানা কারণে নানা জায়গায় আলোচনার বিষয়ে পরিণত- আলোচনার চেয়ে নেতিবাচক সমালোচনা হিসেবেই চতুর্দিকে তা বিস্তৃত। একদল চেনা মানুষ ভারত বিদ্বেষকে নানাভাবে উসকে দিয়ে সাধারণের মনস্তাত্ত্বিক জগতে ঋণাত্মক প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়। পাশাপাশি নানা রকমের নেতিবাচক আলোচনা ও সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে এই গোষ্ঠীটি। গণমাধ্যম এবং সাম্প্রতিককালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা অত্যন্ত তৎপর। পৃথিবীর অন্যত্র সরকারি সফরের চেয়ে ভারতে সফর বেশি সমালোচনার জন্ম দেয় এই কারণে যে, আওয়ামী লীগবিরোধীরা বিশেষত বিএনপি সব সময় জনগণকে এটাই বোঝাতে তৎপর যে, বাংলাদেশ যে কোনো সময় ভারতের অংশ হয়ে যাবে! খালেদা জিয়ার নির্বাচনী জনসভার ভাষণ কখনো শেষ করাই সম্ভব হতো না এরূপ কথা না বললে যে, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে দেশ ভারত হয়ে যাবে! এ দেশের মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে ৫ বার ঘণ্টার ধ্বনি বাজবে, দিল্লি হয়ে যাবে বাংলাদেশের রাজধানী ইত্যাদি কত কী! এরূপ বিষাক্ত বচনের জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে পতঙ্গের উচ্ছ¡াসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এ দেশেরই এক শ্রেণির মানুষ! তারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করত আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে! বিএনপি এখনো এসবই সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করতে চায়! কিন্তু টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও বাংলাদেশ যে ভারতের কাছে বিক্রি হয়নি এটিও সেই আত্মহারা অবিবেচকরা বুঝতে চান না! বুঝতে চান না এ দেশের কোনো মসজিদে কোনো দিন কোনো ঘণ্টারও শব্দ হয়নি! তবু তাদের ধোঁকার কাছেই বোকা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবেন কিছু মানুষ- এটাই যেন তাদের নিয়তি! কিন্তু এসব ভাঁওতাবাজির রাজনীতির দিন শেষ। এখন রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা যুক্ত হয়েছে। দেশকে, দেশের মানুষকে উন্নত জীবনের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ‘মিশন’ ও ‘ভিশন’ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কল্পকাহিনী ও জুজুর ভয় দেখিয়ে রাজনীতির দিন আর নেই। সে কথা দেশের সাধারণ মানুষও বুঝতে শুরু করেছে। শেখ হাসিনার ভারত সফরে এবারো তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়নি বলে অনেকে আক্ষেপ করেছেন। এটি স্বাভাবিক। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এই সফরের এজেন্ডায় থাকলে আগেই টের পাওয়া যেত। এজেন্ডায় থাকা অবস্থায় চুক্তি না হলে আফসোস যৌক্তিক হতো। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে- চুক্তি সম্পাদিত হয়নি বলে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফরকে অনেকে নিষ্ফল বলতে চাইছেন। ‘দৃশ্যমান অর্জন নেই’ বলেও বিএনপি জনগণকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে। অথচ একদা বেগম জিয়া ভারত সফর শেষে দেশে ফিরলে তিস্তা সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন : ‘আমার মনে ছিল না’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকলেও এ নিয়ে সে সময় রঙ্গরস ও ব্যঙ্গকৌতুক কম হয়নি! আগামী নির্বাচনে ভারতের সহযোগিতার জন্য শেখ হাসিনার এই সফর বলে বিএনপিপন্থিরা নিন্দাও করছেন বিস্তর। তিস্তা প্রসঙ্গ বাদ দিলে শেখ হাসিনার এই সফরে প্রাপ্তি উল্লেখযোগ্য। একনজরে সাম্প্রতিক সফরের নিম্নলিখিত সমঝোতা চুক্তিগুলো দেখে নেয়া যেতে পারে : ক. তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানিতে ফ্রি টানজিট দেবে ভারত, খ. কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে সমঝোতা, ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তে চাষাবাদে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন, গ. ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগে বিভিন্ন বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হবে, ঘ. চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য রপ্তানি বন্ধের আগে বাংলাদেশে আগাম জানিয়ে দিতে পদক্ষেপ নেবে ভারত, ঙ. সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ, চ. বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ঐতিহাসিক সড়ক স্বাধীনতা সড়ক চালু করা হবে, ছ. নদী দূষণ এবং অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রে নদীর পরিবেশ এবং নদীর নব্যতা উন্নত করার মতো সমস্যগুলো দ্রুত সমাধান করা হবে, জ. রেলওয়ে সেবার মান বাড়ানোর জন্য আইটি সল্যুশন বিনিময় করা হবে, ২০২২ সালের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে দুদেশের বাণিজ্যিক কর্মকর্তাদের কাজ শুরু করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানিতে ফ্রি ট্রানজিট পাবে বাংলাদেশ। আমরা মনে করি ভারতের এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক সাড়া জাগবে। শুল্ক প্রদানের বিনিময়ে হলেও বাংলাদেশের এ দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। সে ক্ষেত্রে বিনা-শুল্কে ভারতের নিকট এই সুবিধা পাওয়া গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করবে! তিস্তার বিষয়ে অব্যাহত চাপ বজায় রেখে ফ্রি ট্রানজিটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়ের ক্ষতি আংশিক হলেও বাংলাদেশ পুষিয়ে নিতে পারবে। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় জননেত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরকে আমরা সফল বলেই মনে করি। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App