×

সাহিত্য

‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৩৯ এএম

‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’

কবি হেলাল হাফিজ

জ্বলজ্বলে চোখ দুটি কি জ্বলে ওঠলো একটুখানি? যে চোখ জ্বলে ওঠেছিল ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ সময়ে। যে চোখ দুটি পুড়িয়ে বাধ্য করেছিল লিখতে, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ যে লেখা রাতারাতি এনে দিয়েছিল ‘তারকা’ খ্যাতি। যে লেখা লাখো-কোটি প্রাণে জ্বালিয়ে দিয়েছিল প্রেম-দ্রোহের আগুন। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ জাগানিয়া সেই চোখ আজ বড্ডো নিষ্প্রভ, বড়ো অভিমানী, বড়ো বেশি অশ্রুসিক্ত। বেদনাকে কেঁদো না বললেও হৃদয়ের কান্নাকে চাপা দিতে পারছে না পোড়া চোখ। ছলছল দৃষ্টি, প্রিয় সানিধ্যের ব্যাকুলতা, কথা বলার পরিতৃপ্তি- সব মিলিয়ে তার মধ্যে এক শিশুর সারল্য। তবুও কারো কাছে কোনো চাওয়া নেই। নেই কোনো অনুযোগ-অভিযোগ। স্মিত হেসে বললেন, এখন যে কদিন পরমায়ু আছে, মোটামুটি সুস্থ থাকতে পারলেই ভালো- এটাই শুধু চাওয়া।

ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান তরুণ কবি হেলাল হাফিজ। আন্দোলনের সুতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে লেখা হলো, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ মাত্র দুই রাতেই ‘চিকা’ মারা শেষ। কবিও তখন যেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু।’ এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার পাশাপাশি আজও কণ্ঠে কণ্ঠে ফেরে অস্ত্র সমর্পণ, অগ্ন্যুৎসব, বেদনা বোনের মতো, ইচ্ছে ছিল, অশ্লীল সভ্যতা, প্রস্থান, যাতায়াত, ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, হৃদয়ের ঋণ, নাম ভূমিকায়, ইচ্ছে ছিল, একটি পতাকা পেলে। কাব্যপ্রেমীদের কাছে তিনি কখনো দ্রোহী, কখনো প্রেমিক আবার বিরহের মূর্ত প্রতীক।

মাত্র ৫৬টি কবিতা নিয়ে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থে জাতির কাব্যিক হৃদয়ে প্রেম-বিরহ-দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। ১৯৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের বৈধ সংস্করণের সংখ্যাই ত্রিশের কোঠায়। আর দেশ-বিদেশে অবৈধ সংস্করণ দুইশ’ ছাড়িয়ে গেছে বলেই ধারণা পাঠক-মহলের। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ৩৪ বছর পর ৩৪টি কবিতা নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। চির যৌবনের কবি হেলাল হাফিজ আজ ভালো নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠিক নেই শরীর। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে অনেক অর্গান। গুরুতর সমস্যা করছে চোখ। কিডনি, ডায়াবেটিস, স্নায়ু জটিলতার মতো সমস্যাগুলো তো রয়েছেই। এরচেয়েও বেশি সমস্যা একাকিত্ব, ‘মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’। ভর্তি ছিলেন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে থাকতে ভালো লাগছিল না, তাই চলে যান হোটেল সুপার হোমে। সোমবার বিকালে শাহবাগের সুপার হোমের লবিতে গিয়ে দেখা যায়, কবিকে দেখতে এসেছেন ১০-১২ জন কবি ভক্ত। কবি অনুমতি দিলে কবির সেবা-শুশ্রূষা করতে থাকতে চান তারা। কিন্তু কবির অনুমতি মিলে না। বললেন, দুঃখ, বেদনাকে যে শিল্পে রূপান্তর করতে পারেন, সেই তো প্রকৃত কবি। আমি নিজেই তো লিখেছি ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।

স্মিত হেসে বললেন, আমি হোটেল জীবন এনজয় করি। নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা আমার ভালো লাগে। একাকিত্বের এই বেদনাকে আমি উপভোগ করি। কোভিডকালে তো পরিবারের সঙ্গে ছিলেন, এখন আবার হোটেল জীবনে ফিরে এলেন কেন- এমন প্রশ্নে কবির বক্তব্য, আমার নিজের পরিবার নেই। আমি একা মানুষ। ছোটবেলায় আমার মা মারা যান। কিছুদিন পর বাবা আবার বিয়ে করেন। ২ ঘর মিলিয়ে আমরা ৪ ভাই, ৩ বোন। তারা সব সময় আমার খবর রাখে। ঢাকায় আমার বড়ভাই থাকেন। কোভিডে তার সঙ্গে ছিলাম। সেখানে স্পেস কম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এখনো খুব অসুস্থ। সিএমএইচে দেড় মাস চিকিৎসা নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আমার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেছেন, সেজন্য কৃতজ্ঞ আমি। এরপর হোটেলে ফেরার পর আবারো হঠাৎ করে সুগার ফল করল। পরে পরিচিতজনরা বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতাল আমার ভালো লাগে না। তবে চিকিৎসকদের টাচে রয়েছি।

ভাদ্র মাসের পড়ন্ত বিকালে বিজলি আলোর রোশনাইয়ের শহরে বড্ডো বেমামান মুষলধারে বৃষ্টির সঙ্গে চির যৌবনের কবির এক জীবনের গল্প শুনতে শুনতে সন্ধ্যে হয়ে এলো। জীবনের আলো-আঁধারির খেলায় কবিও যেন অনেক বেশি ক্লান্ত। দ্রোহ, প্রেম ও বিরহের কবি হেলাল হাফিজ যেখানে সবকিছুকে তুচ্ছ করে বলেছেন, ‘এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে’। তবে কি প্রথম জীবনের দ্রোহ, অবজ্ঞা করার ক্ষমতা পরিণত হেলাল হাফিজে এসে ম্রিয়মাণ? কবি বলেন, আমার যাপিত জীবনে বেদনা অক্সিজেনের মতো কাজ করে। ভালোবাসাহীন সমাজ, চারদিকে মাতাল হাওয়া, খুন, ধর্ষণ, নৃশংসতা। এর উল্টোস্রোতে দাঁড়িয়ে আমি ভালোবাসার কথা বলেছি। এটাও তো এক ধরনের প্রতিবাদ। পচে যাওয়া সমাজের প্রতি অবজ্ঞার চাবুক। আর কবিতার জন্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, এক জীবনে আর কত চাই?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App