×

মুক্তচিন্তা

পারমিতার মতো আর কেউ যেন চলে না যায়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:১৪ এএম

পারমিতা ফাইহা বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে তার আত্মহত্যার সঠিক কারণটা হয়তো জানা যেত। সে নিজের মুখেই বলত, কেন তাকে চলে যেতে হলো। কোন অভিমান ও অস্বস্তি তাকে চলে যেতে বাধ্য করল। সময়ের আগেই তাকে জীবনের পরিসমাপ্তি টেনে দিতে হলো। তবে সহপাঠীরা তার পক্ষে কথা বলছে, তার কথাই যেন বলছে। সহপাঠীরা আত্মহত্যার কারণ বলছে। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করানোর অভিযোগ তুলেছে। জানা যায়, স্কুলের এক শিক্ষক তাকে বাসায় প্রাইভেট পড়তে বলেছিলেন। পারমিতা রাজি না হওয়ায় উচ্চতর গণিতে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় তাকে অকৃতকার্য করা হয়। এতে স্কুলের অধ্যক্ষ পারমিতার অভিভাবকদের সাক্ষাৎ করতে বলেন। বিষয়টি পারমিতাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে, প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলে। অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে। পড়াশোনায় বরাবর ভালো ফল করা মেয়েটি বিষয়টি সহ্য করতে পারেনি। সহপাঠীদের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে সে আলাপ করে বলে জানা যায়। উল্লিখিত অভিযোগ সহপাঠীদের, অভিভাবকদের নয়। পুলিশ বলছে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এই অপমৃত্যুর জন্য কোনো অভিযোগ বা মামলা করা হয়নি থানায়। এমনকি পারমিতার অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশ কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি, পারছে না। তবে তারা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে প্রচারমাধ্যমে বলেছেন। পারমিতা বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। পরিপাটি, প্রতিষ্ঠিত স্কুল। জানা যায় একটি সেকশনের সে ফার্স্ট গার্ল। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় অধ্যক্ষ কর্তৃক অভিভাবকদের ডেকে পাঠানোর বিষয়টি সে মেনে নিতে পারেনি। তাই নিজ বাসভবনের ১২ তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে জীবনের ইতি টেনেছে। যখন লেখাটা লিখছি ততক্ষণ পর্যন্ত পারমিতার অভিভাবকদের কোনো অভিযোগ বা মামলার খবর পাওয়া যায়নি। যাই হোক, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, হতাশা, বিষণ্নতা, বিপর্যস্ততা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি অনেক কারণে ব্যক্তি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে এর পেছনে প্ররোচনা বলে এক ধাক্কা থাকে। সাধারণত থাকতে দেখা যায়। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতিকূলতা থেকে এই প্ররোচনার ধাক্কার উৎপত্তি। যার দায় সমাজের কেউই নিতে চায় না, চায়নি। ফলে আত্মহত্যার মতো অপমৃত্যু সমাজ থেকে সহজে যায় না, রয়ে যায়। সংখ্যা বাড়ে। আত্মহত্যার প্রবণতা বিশ্বজুড়েই আছে, থাকে। মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যার অনেক কারণ উল্লেখ করে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ থেকে এই আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যক্তির ভেতর দেখা দিতে পারে। আবার যে সমাজে ব্যক্তির বসবাস, সেই সমাজের নানান অসঙ্গতি ব্যক্তিকে অপমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তবে বাংলাদেশে যে কারণে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় তার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজের অসঙ্গতিগুলো কারণ হিসেবে থেকে যায়। সহপাঠীদের ভাষ্য অনুযায়ী সত্যিই যদি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে না চাওয়ায় পারমিতাকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করানো হয় এবং অধ্যক্ষ কর্তৃক অভিভাবকদের ডেকে কথা বলার বিষয়টি মারাত্মকভাবে তাকে বিষাদগ্রস্ত করে, অস্বস্তিতে ফেলে আর সেই কারণে সে আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে এই আত্মহত্যার পেছনে অসুস্থ ও অব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সমাজ ব্যবস্থাকেই একবাক্যে দায়ী করা যায় নিশ্চিতভাবে। স্কুল সেই সমাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান বিধায় সেটাও অব্যবস্থাপনায় ও অসুস্থভাবে পরিচালিত হয় বলে মনে করা অযৌক্তিক হবে না মোটেও। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অমানবিক, নিষ্ঠুর ও অসৌজন্যমূলক আচরণ নতুন নয়। হরহামেশাই দেখা যায়, শোনা যায় সেইসব কথা। এমন আচরণে ইতোপূর্বে দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠিত স্কুলের শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যা করতে দেখা গেছে। প্রতিকারের লক্ষ্যে এ নিয়ে খুব কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিংবা সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বিষয়টিকে খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হয়নি, হয় না বলেই অনেক অভিভাবক মনে করেন। এ কথা বলা কতটা অযৌক্তিক হবে যে, শিক্ষা এখন বাণিজ্যের অন্যতম এক উপকরণ বা উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ্য ও আদর্শচ্যুত হয়ে এবং সার্বিক নজরদারির অভাবে শিক্ষা বিষয়টি ধীরে ধীরে উত্তম বাণিজ্যে উপনীত হয়েছে। এক শ্রেণির ব্যক্তি শিক্ষকের লেবাসে তাদের ফায়দা লুটছেন। আগে শিক্ষক ও সাংবাদিক পেশাকে ছা-পোষা হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। কারণ এই দুই পেশাজীবী দেশপ্রেমে আত্মনিবেদিত, ত্যাগে মহিমান্বিত হয়েই বেঁচে থাকতেন। থাকতে ভালোবাসতেন। অর্থ, ধন-দৌলত, সম্পদ, প্রাচুর্য তাদের স্পর্শ করেনি। শিক্ষক স্বপ্ন দেখতেন, তার ছাত্রকে ভালোমতন পড়াতে হবে ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটাই তাদের একমাত্র মহান ব্রত ছিল। পরবর্তীতে শিক্ষার সংস্কৃতি বদলে যায়। আধুনিকতার অজুহাতে, প্রযুক্তির দোহাইতে শিক্ষার কৌশল, পদ্ধতি বদলে যায়। বদলে দেয়া হয়। প্রাণহীন, স্পর্শহীন হয়ে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা। আদর্শের বালাই থাকে না। উপরন্তু প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং, নোট সাপ্লাই ইত্যাদি কার্যক্রম দ্বারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে টাকা কামাইয়ের এক উত্তম পন্থা, পথ হিসেবে পরিচিত করে শিক্ষক সমাজের একটা অংশ। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ, ধন, সম্পদ, প্রাচুর্য হাতের নাগালে সহজে পৌঁছে যায়। ফলে শিক্ষক পেশাটি কারো কারো জীবনে আভিজ্যত্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ছা-পোষা আর থাকে না। একই দৃশ্য সাংবাদিক পেশাতেও। সাংবাদিক পেশার আদর্শটাও যেন ব্যবসায়িক ধারায় প্রবাহিত। দেখা যায় যে, প্রায় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি করে পত্রিকা অফিস আছে। যার কাজ হলো, ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা। প্রকৃত সাংবাদিকতার চর্চাটা এখানে হয় না। মালিক টাকা, সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে কতিপয় সাংবাদিকের মাথা কেনেন। আবার কিছু অসাংবাদিককে সাংবাদিকের আসনে বসান। কতিপয় সাংবাদিক আবার টাকার বিনিময়ে সংবাদ পরিবেশনের উপায়, কৌশল রপ্ত করে অভিজাত হন। শিক্ষক ও সাংবাদিক পেশার ব্যক্তিরা এখন ছা-পোষা, এ অভিমত প্রকাশের সুযোগ আর থাকে না। পারমিতা প্রাইভেট না পড়ায় শিক্ষক তাকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করিয়েছেন- এই অভিযোগ সত্য কি মিথ্যে সেটা কীভাবে প্রতীয়মান হবে তা জানা নেই। তবে মাত্র কিছুদিন আগে যে, শিক্ষা নীতি প্রকাশ করা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাতে উল্লেখ ছিল যে, কোনো শিক্ষক তার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে কোচিংয়ে পড়াতে পারবেন না। তবে বাইরের অন্য শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন। এমন নীতি যে কতটা ধোঁয়াটে, অস্বচ্ছ এবং অবিজ্ঞানসম্মত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ যেন কোচিং ব্যবস্থায় একজন শিক্ষকের সহজ বিচরণের সুযোগ দিয়ে রাখা। স্কুল কর্তৃপক্ষের এমন কোনো হাতিয়ার আছে কিনা তার প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক এই নিয়ম ভেঙেছে কিংবা ভাঙছে কিনা, তা যাচাই ও চিহ্নিত করা যায়? জানা নেই যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কীভাবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিটরিং করা হয়। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও প্রত্যাশাগুলো নির্বিঘেœ সরাসরি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ থাকা দরকার। শুধু আমলা নয়, মন্ত্রণালয়ে সুশীল সমাজের সদস্য নিয়ে কমিটি থাকবে যারা নিয়মিতভাবে এইসব অভিযোগ ও প্রত্যাশা জানবেন এবং সেই আলোকে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে পরামর্শ দেবেন। এটা জোর দিয়ে বলি, শিক্ষাই দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প হওয়া উচিত। সুস্থ, সুষ্ঠু পরিবেশ, কৌশল, অবাণিজ্যিক মনোভাব প্রতিটি স্কুলে যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতার চর্চা চালু করতে হবে। পরীক্ষায় পাস দিয়ে সাফল্য গোনার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে। আবার অভিভাবকের অধিক প্রত্যাশা সন্তানকে বিষাদগ্রস্ত করে দেয়। জীবন নিরানন্দ হয়ে ওঠে। কারণ সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও আসতে পারে। এই মানসিক প্রস্তুতিও থাকতে হয়। অনেক অভিভাবক সন্তানের পরীক্ষায় কৃতকার্যতা নিয়েই বেশি মুখর থাকেন। ফলে সন্তান কখনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তা তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না। যেটা সন্তানের জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে সন্তান বিকল্প পথ খোঁজে। অভিভাবকদের সচেতন ও সতর্ক হওয়া জরুরি। পারমিতার ক্ষেত্রে কোন কারণটা মুখ্য ছিল তা তার অবর্তমানে খোঁজা, অনুসন্ধান করা বোকামি। তবে একটা কারণ তো ছিলই যেটা তার অনুপস্থিতিতে বের করা আর সম্ভব নয়। সন্তানেরা বাবা-মায়ের জীবনের পরম সম্পদ, পরম পাওয়া। এর বিকল্প নেই। হয় না। সন্তানকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার একটি পর্যায়ে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি তার জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে বলার আর কী থাকে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সমাজের অসঙ্গতি ও অব্যবস্থাপনার শিকার হলে তার প্রভাব দেশের ভবিষ্যতের ওপর গিয়ে পড়বে তা মনে রাখা দরকার। পারমিতার মতো কোনো জীবন প্রদীপ যেন এভাবে না নিভে যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App