×

পুরনো খবর

ভীষণ সরব ফ্যাশনেও!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৭:৩৮ পিএম

ভীষণ সরব ফ্যাশনেও!

প্রতীকী ছবি

আবিষ্কার হয়েছিল প্রায় ১৭৩ বছর আগে। সাধারণ জিনিস। কিন্তু গুণের শেষ নেই। নাম সেফটিপিন। এটি খুব হেলাফেলার বিষয় আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে। তবে সেফটিপিন ফ্যাশনজগতের এক অদ্ভুত সংযোজন। ভীষণ সরব তার উপস্থিতি ফ্যাশন দুনিয়া হয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে। ফ্যাশন অনুসঙ্গ হিসাবে রীতিমত ট্রেন্ডেং!

সেফটিপিন কিন্তু খুবই জরুরি জিনিস। শাড়িতে কুঁচির ভাজ মেলাতে, শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজের মেলবন্ধন করতে, সালোয়ারের সঙ্গে ওড়না আটকাতে, চলতি ভাষায় যাকে বলে পিন করা এই ক্ষেত্রে সেফটিপিনের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কারণেই সেফটিপিনের আদি নাম ছিল, ‘ড্রেস পিন’। আদতে ড্রেস পিন নাম থাকলেও সমসাময়িক ফ্যাশন ট্রেন্ডে গয়না বা পোশাক সবকিছুতেই ভ্যালু এডিশন হিসাবে কাজ করেছে এটি।

সেফটিপিনের জন্ম আমেরিকায়। ১৮৪৯ সাল। আমেরিকায়। আবিষ্কারক বিখ্যাত যন্ত্রকৌশলী ওয়াল্টার হন্ট। খুব স্বাভাবিক নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, আবিষ্কারক একজন পুরুষ। তবে যে উদ্দেশ্যে এখন সেফটিপিন ব্যবহার করা হয় সেই উদ্দেশ্যে তিনি আবিষ্কার করেননি। তিনি করেছিলেন ধার শোধ করতে। শুনে খানিক ধাঁধা লাগলেও এই ছিল সেফটিপিন আবিষ্কারের আসল কারণ।

ওয়াল্টারের ছোটখাটো জিনিসের উদ্ভাবন ক্ষমতা ছিল। মাঝে মধ্যেই ঝোঁকের বশে নানা জিনিস বানাতেন। একদিন ভাবছিলেন, কীভাবে ধার শোধ করা যায়। হাতে তো কিছুই নেই, নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করবেন কি! যদি নতুন কিছু বানিয়ে সেটা বিক্রি করে খানিক অর্থ সংস্থান হয়, মন্দ হয় না। এইসব সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যেই লম্বা তারের টুকরো আড়াআড়ি দুবার বাঁকালেন, মাথায় পরালেন একটা খাপ, যাতে গায়ে ফুঁটে না যায়। অর্থাৎ পিন কিন্তু সেফ। ব্যস, তৈরি হল সেফটিপিন। ১৮৪৯ সালের ১০ই এপ্রিল তিনি পেটেন্টের জন্য আবেদন করলেন। সেই পেটেন্ট বিক্রি হল ৪০০ ডলারে। ধার শোধ তো হলই। কিছুদিনের মধ্যেই সেফটিপিনের বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন শুরু হল ওয়াল্টার হয়ে উঠলেন লাখ লাখ ডলারের মালিক।

যে বন্ধুর থেকে ওয়াল্টার ধার করেছিলেন, নির্ধারিত পনেরো ডলার শোধের সময়, তিনি সঙ্গে দিয়েছিলেন একটি সেফটিপিন। কারণ তার তাগাদায় বা উপরোধেই না এই জিনিসের জন্ম। সেটি ৮ ইঞ্চি লম্বা ছিল যার একপাশে দন্ড দুটিতে তারের কয়েল লাগিয়েছিলেন যেটি স্প্রিংয়ের ভূমিকা পালন করেছিল এবং অন্যপাশে একটি দন্ড ছিল যেটি আবদ্ধ রাখতে সাহায্য করেছিল।

সেফটিপিনের আদি নাম ‘ড্রেস পিন’। মানে এই পিন দিয়ে কাপড় আটকানো হতো। তবে পিন দিয়ে কাপড় আটকানো অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। মধ্য ব্রোঞ্জযুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৫০-১৫৪০) মধ্য ইউরোপে এটির সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। এরপর বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে কাপড় আটকানোর পিন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা আধুনিক সেফটিপিন পেয়েছি, সেটাও কাপড় আটকানোর জন্যই। এখন যে অল ইন ওয়ান ডায়াপার দেখা যায় মূলত শিশুদের ব্যবহারের জন্য, উনিশ শতকেও এ রকম ডায়াপার ব্যবহার করা হতো আমেরিকা আর ইউরোপে। সেগুলোর সাধারণ নাম ছিল ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাট বা এখনকার অল ইন ওয়ান ডায়াপারের পূর্বসূরি ডায়াপারগুলো আটকানো থাকত পিন দিয়ে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে, অর্থাৎ ১৮৪৯ সালের পর থেকে কাজটি করে আসছে সেফটিপিন। এ ছাড়া কাপড় আটকাতে তো তার ব্যবহার ছিলই। আমেরিকা বা ইউরোপে বিশেষত নারীদের পোশাকের যে ধরন ছিল আঠারো বা উনিশ শতকে, তাতে পিনের মতো একটা কিছুর প্রয়োজন হতোই। সে জায়গাটা পূরণ করে সেফটিপিন।

তবে সেফটিপিন ফ্যাশনজগতের আইকন হয়ে ওঠে বেশ পরে। বলা চলে উনিশ শ সত্তরের দশকে। এর পেছনে তখনকার পাংক রক শিল্পীদের অবদান অনেক বেশি। পাংক রক শিল্পীদের অনেকেই ফ্যাশনের জন্য সেফটিপিন ব্যবহার করতেন বিশেষভাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন পোস্টারেও সেফটিপিন ব্যবহার করে গেছেন তারা। পাংক রক এবং সেফটিপিনের কথা উঠলেই উঠে আসে বিশ শতকের সত্তরের দশকের বিখ্যাত ব্যান্ড ‘সেক্স পিস্তল’-এর কথা। সম্ভবত এই ব্যান্ড সেফটিপিনকে ফ্যাশনের জগতে প্রতিষ্ঠা করে গেছে।

ব্রিটিশ এই পাংক রক ব্যান্ডের গানের নাম ‘গড সেভ দ্য কুইন’। এখানে দেখা যায়, ভোকাল জনি রটেন অনেকগুলো সেফটিপিন দেওয়া একটি শার্ট গায়ে দিয়েছেন। এর আগে পাংক রক ব্যান্ডের কাউকে সেফটিপিন ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এরপর থেকেই পাংক রক সংগীত জনরার শিল্পীদের মধ্যে সেফটিপিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় বলে মনে করেন অনেকে। অবশ্য তার আগে ওই সত্তরের দশকেই ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার ভিভিয়ান ওয়েস্টউড তাঁর নকশা করা পোশাকে, বিশেষত টি-শার্টে, সেফটিপিনের ব্যবহার করেছেন। সেই সত্তরের দশকেই ফ্যাশন ডিজাইনার জান্ড্রা রোডস, জুডি ব্লেমের মতো ফ্যাশন ডিজাইনাররাও তাঁদের পোশাক ও গয়নায় সেফটিপিন ব্যবহার করেন।

বিশ্ব ফ্যাশনজগতে এই ধারা চলতে থাকে উনিশ শ নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। স্টিফেন স্প্রাউস কিংবা জিন পল গালটিয়ারের মত ফ্যাশন ডিজাইনার এবং এলিজাবেথ হার্লের মত অভিনেত্রীরা ফ্যাশনের জগতে সেফটিপিনকে অমরত্ব দিয়ে গেছেন। সে ধারা যে এখনো চলছে, সেটা না বললেও চলে। ২০১৬-১৭ সালের শরৎ বা শীতের পোশাকের কালেকশনে বালেনসিগা, ভায়নেট ও সোনিয়া রাইকিয়েলের মতো বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনাররা সেফটিপিনকে আবারও ফ্যাশনের ঝাঁ-চকচকে মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেফটিপিন বিশ্ব ফ্যাশন মঞ্চের রঙিন দুনিয়ায় আসার আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার ব্যবহারিক কারণে। শুরুতেই বলেছি, শুধু ইউরোপ কিংবা আমেরিকাই নয় অথবা চকচকে চেহারার তন্বী মডেলরাই শুধু নন, আমাদের দেশের সাধারণ নারীরা প্রতিদিন ব্যবহার করে চলেছেন সেফটিপিন। বিভিন্ন রকম ধাতুতে বানানো প্রজাপতি, মৌমাছি কিংবা বিভিন্ন ফুলের পেছনে লাগানো সেফটিপিন একসময় শিশুদের ফ্যাশনেও ব্যবহার হয়েছে আমাদের দেশে। হ্যাঁ, সেগুলো ফ্যাশন দুনিয়ার চলতি ফ্যাশনের অক্ষম অনুকৃতি ছিল বটে। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের চলতি ফ্যাশনের জগতে তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

যাহোক, পাংক রকের মত একটি সংগীত জনরার ফ্যাশন আইকন হয়ে ওঠা এই খুবই ছোট্ট অনুসঙ্গের প্রতি মানুষের একধরনের আধ্যাত্মিক যোগাযোগের কথাও শোনা যায় বিভিন্ন লেখায়। জানা যায়, হোমার তার ‘ওডিসি’ মহাকাব্যে কাপড়ে ব্যবহার করা পিনের কথা লিখেছিলেন, যার রং ছিল সোনালি, সেই পিনের বর্তমান রূপ সেফটিপিন। উনিশ শ তিরিশের দশকেও সোনালি রঙের সেফটিপিন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, ইউরোপে।

তিনের দশকে ইউরোপে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল সোনালি রঙের সেফটিপিন। সে ক্রমে হয়ে ওঠে ফ্যাশনজগতের আইকন।

সেফটিপিন দিয়ে গিনেজে বুকে বাংলাদেশ

সেফটিপিন দিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম চেইন তৈরি করে গিনেস বুকে নাম লেখান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক গ্রামের পার্থ চন্দ্র দেব।

২৭ বছর বয়সী এই তরুণের হাতে ২০২০ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর পৌঁছায় বিশ্বরেকর্ড গড়ার সার্টিফিকেট। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি শেষ বর্ষে পড়–য়া পার্থ ৭ হাজার ৮৭৭ ফুট দৈর্ঘ্যের সেফটিপিনের চেইন তৈরি করেন। তার তৈরি এই চেইনে ব্যবহার করা হয়েছে সোনালি রঙের ১ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৩টি সেফটিপিন। এই রেকর্ড গড়তে পার্থের ব্যয় হয় ৪৫ দিন। সময় লেগেছে ২৪১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। সময়ের এই হিসাব তিনি করেছেন সিসি ক্যামেরায়। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ নিজের জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে গিনেস কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করেন তিনি। ২০ এপ্রিল গিনেস কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ওয়েবসাইটে গিয়ে “দ্য লংগেস্ট চেইন অব সেফটিপিন” এই ক্যাটাগরিতে আবেদন করেন। ১৯ জুলাই তা গ্রহণ করে গিনেস কর্তৃপক্ষ।

আবেদন গ্রহণের সঙ্গে তারা চেইন তৈরির প্রায় ১৪টি নিয়মও জুড়ে দেন। একে একে গিনেস কর্তৃপক্ষের দেওয়া সব নিয়ম মেনেই প্রতিযোগিতায় নামেন পার্থ। আট মাস পর পার্থের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয় গিনেস।

সোর্স: বিলবোর্ড, আনন্দবাজার পত্রিকা ও লাভ টু নো ডট কম

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App