×

মুক্তচিন্তা

সময়ের শুভ উদ্যোগ : তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:২৫ এএম

সময়ের শুভ উদ্যোগ : তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী

‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের পরে আবারো সংশোধন করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রণীত বিদ্যমান আইনটির দুর্বলতা নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রশংসনীয়। ২০১৩ সালে কিছু সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তবুও সময়ের চাহিদা বিবেচনায় উক্ত আইনটির কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। কেননা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার ঘোষণা প্রদান করেছেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে তার এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য। সেই উদ্যোগের বড় রসদ এবং প্রধান অস্ত্র হলো ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। মূলত ২০০৩ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে সেটিকে ভিত্তি ধরেই দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৫ সালে আইনটি প্রণয়নের পরে ১৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর বাস্তবায়নে ধীরগতি সত্ত্বেও আইন প্রণয়ন পরবর্তী তামাকবিরোধী সচেতনতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অধূমপায়ীরা তামাকের কারণে পরোক্ষভাবে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, নিজেদের সেই অধিকার নিয়ে তারা প্রতিবাদ করে। ধূমপায়ীরাও নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সচেতন হয়েছে। পাবলিক পরিবহনে ধূমপান কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। যদিও বর্তমানে যত্রতত্র অহরহ ধূমপান করতে দেখা যায়। আশাব্যঞ্জক সংবাদ হচ্ছে- গেøাবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-তে ২০০৯ সালের ৪৩.৩ শতাংশ থেকে নেমে ২০১৭ সালে এসে ৩৫.৩ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে তামাক সেবনের হার কমেছে ৮ শতাংশ। এতদসত্ত্বেও বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকের কারণে মৃত্যুবরণ করে। প্রায় ৪ কোটি মানুষ পঙ্গুত্বের শিকার হয়। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি! উপরন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো- তামাক কোম্পানিগুলো বসে নেই। তামাকের ব্যবসা সম্প্রসারণের যত কূট-কৌশল ও অনৈতিক পন্থা রয়েছে, তার সবকিছুই প্রয়োগ করছে আমাদের আগামী প্রজন্মকে তাদের ভোক্তা অর্থাৎ ধূমপায়ী বানানোর জন্য। মূলত বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছু ক্ষেত্রে ফাঁক-ফোকর থাকার সুযোগ নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। ফলে আইন প্রণয়নে উদ্দেশ্য হাসিল বা সুফল আশান্বিতভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তামাক নিয়ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সমন্বয় সাধন এবং প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণ। প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তোরণের একটি উপায় হচ্ছে- দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে অধিকতর শক্তিশালী করা। যাতে আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়। বাংলাদেশ তরুণের দেশ। বর্তমানে আমাদের ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। দেশে মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ কর্মক্ষম (প্রায় ১১ কোটি)। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী তামাক কোম্পানি ও মাদক কারবারিদের প্রধান টার্গেট। গবেষণায় দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ ধূমপায়ী মাদকের নেশায় ধাবিত হয়, যার সিংহভাগ তরুণ। তামাক কোম্পানিগুলো এই তরুণদেরই তামাকের প্রতি প্রলুব্ধকরণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে কৌশলে, আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে। সেই কৌশলের একটি অংশ হলো যত্রতত্র তামাকের বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন এবং খালি ও ডামি প্যাকেট দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়ে রাখা। স্টিকার, ফ্লাইয়ার, ব্র্যান্ডের রং, মূল্য তালিকা প্রদর্শন করেও বিজ্ঞাপন চালায় কোম্পানিগুলো। আইনের খসড়া সংশোধনীতে (ধারা : ৫) ‘ক্রেতার নিকট বিক্রয়ের সময় ব্যতীত বিক্রয়স্থলে (ঢ়ড়রহঃ ড়ভ ংধষবং) সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য বা উহার মোড়ক বা প্যাকেট দৃষ্টির আড়ালে রাখিতে হইবে।’ মর্মে প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশ্নাতীতভাবে তা চূড়ান্ত করা উচিত। কেননা চোখের আড়াল হলে এ সব ক্ষতিকর পণ্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যাবে। বিশেষত শিশু-কিশোররা এর থেকে দূরে থাকবে। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের চোখের সমান উচ্চতায় এবং ক্যান্ডি, খেলনার পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন তামাক কোম্পানিগুলোর প্রচারণা এবং শিশু-কিশোরদের তামাকে আকৃষ্ট করার কৌশল। আমাদের কিশোর-তরুণদের তামাকের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে এ ধারাটির সংশোধনী অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। এছাড়াও স্কুল-কলেজসহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান না রাখার যে বিধান যুক্ত করা হয়েছে আইনের সংশোধনীতে তা আরেকটি চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। ধারা-৬ এ অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বয়সসীমা আরো বাড়িয়ে অনধিক ২০ বছর করতে হবে যেন উঠতি বয়সিরা তামাকের ধারে-কাছে না থাকে। আইনের ধারা-৭ এ পাবলিক প্লেসে ‘ধূমপান জোন’ না রাখার জন্য প্রস্তাবনা এসেছে। আমাদের বিদ্যমান আইনে ‘পাবলিক প্লেস’ ও ‘পাবলিক পরিবহনে’ ধূমপান নিষিদ্ধ। তবে কিছু পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে মালিক/তত্ত্বাবধায়ক দ্বারা ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘উবংরমহধঃবফ ঝসড়শরহম তড়হব’ রাখার কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে রেস্টুরেন্টগুলোতে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বেশি চোখে পড়ে। কোম্পানিগুলো স্পন্সরের মাধ্যমেও এগুলো তৈরি করছে বলে জানা যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, এসব পাবলিক প্লেসে অনেক মানুষের যাতায়াত। ধূমপানের স্থান তৈরিতে যথাযথ নিয়ম মানা হয় না এবং আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশপাশের স্থান বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ামুক্ত হয় না। এতে অধূমপায়ীরা (বিশেষত : নারী ও শিশুরা) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। গেøাব্যাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭-তে দেখা যায়, ৪৯.৭ শতাংশ মানুষ রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে তা ৪২.৭ শতাংশ এবং গণপরিবহনে প্রায় ৪৪ শতাংশ। সংখ্যায় যা প্রায় ৮ কোটি! পরোক্ষ ধূমপান অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় শতকরা ২০-৩০ ভাগ। বিশ্বে ৬৯টি দেশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেসে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। সুতরাং পাবলিক প্লেস ও পরিবহনগুলো শতভাগ ধূমপানমুক্ত রাখতে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি। কোভিড মহামারি সামলাতে বহু প্রচেষ্টা দেখেছি, নিজেও সাধ্যমতো করেছি। এবার নীরব মহামারি ‘তামাক’ রুখতে হবে। বিশ্বে ৮০ লক্ষাধিক এবং দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ এই তামাকের আগ্রাসন রুখতে না পারলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশেরও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করবে। কারণ আমাদের আগামীর বাংলাদেশের কর্ণধার আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবারা। যাদের ভোক্তা বানিয়ে অর্থের বাণিজ্য ঊর্ধ্বমুখী করতে চায় তামাক কোম্পানিগুলো। সরকারকে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। তামাকের ব্যবসায়ীরা আর এ খাতের সামান্য রাজস্ব নয়, জনস্বাস্থ্য এবং আমাদের তরুণরাই প্রাধান্য পাবে সবকিছুর উপরে। প্রাধান্য পাবে মানবজীবনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ- পরিবেশ-প্রতিবেশ, যা তামাকে বিষে নীল হতে চলেছে অবলীলায়।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : কলাম লেখক, চিকিৎসক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App