×

মুক্তচিন্তা

উন্মুক্ত সীমান্ত-বিপন্ন আমেরিকা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৩২ এএম

Borders secure the nation, এই প্রবাদ বর্তমান বিশ্বায়নের যুগেও অস্বীকার করার উপায় নেই। এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে, শত্রæর আক্রমণ প্রতিহত করতে, অস্ত্রের চোরাচালান, বেআইনি ড্রাগ বাণিজ্য, পশু ও কাঁচামালসহ মানবপাচারের মতো মারাত্মক অপরাধ প্রতিহত করতে প্রত্যেক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে সুনির্দিষ্ট সীমান্ত রয়েছে। সেই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সীমান্ত পলিসি। সীমান্ত পলিসি সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বর্ডার প্যাট্রোলিংয়ের মাধ্যমে। বাস্তব অবস্থা যাই হোক, সংবিধানে সীমান্ত পলিসি স্ট্রিক্টলি মেনে চলার হুকুম সবার জন্য পালনীয়। সীমান্ত দুই ধরনের। এক. ন্যাচারাল বর্ডার (যেমন নদী, সমুদ্র, মাউন্টেইন রেঞ্জ কিংবা অন্য কোনো ভৌগোলিক আইটেম দিয়ে নির্দিষ্ট)। দুই. পলিটিক্যাল বর্ডার (যা লাইন দিয়ে এঁকে ম্যাপে দেখানো হয়)। আধুনিক বিশ্বে ৫২.২ পার্সেন্ট সীমান্ত ‘পলিটিক্যাল বর্ডার’। জন্ম, কুড়ি শতকে দুই বিশ্বযুদ্ধের পরে। অবশ্য সীমান্তের গুরুত্ব সবাই যে একইভাবে অনুসরণ করে, তা নয়। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে এটাও সত্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত পলিসি ইন্টারন্যাল বর্ডারে ঢিলেঢালা হলেও এক্সটারন্যাল বর্ডারে আইনকানুন সিস্টেমেটিক্যালিই মেনে চলা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রেও সীমান্ত এবং সীমান্ত পলিসি রয়েছে। ইউএস কাস্টমস এবং সীমান্ত সুরক্ষা নীতিমালা যথেষ্ট শক্তিশালী। ফেডারেল এজেন্সি ঈইচ (ট.ঝ পঁংঃড়সং ধহফ নড়ৎফবৎ ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ) সংস্থার প্রধান দায়িত্ব যেমন বৈধ ট্রাভেলার এবং বৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের ব্যবসায়িক জিনিসপত্রের আগমনকে অভিনন্দিত করা (সব রকম আইনসঙ্গত বৈধ কাগজপত্র দেখানোর পরে), তেমনি টেরোরিস্ট, অস্ত্রশস্ত্র, অবৈধ মাইগ্র্যান্টদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করাও কর্তব্য। কিন্তু ২০২১ থেকে ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার পাশাপাশি এখানকার নীতিমালাও দৃশ্যত বদলে গেছে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে প্যাট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা বর্তমানে ঠুঁটো জগন্নাথ। ঈইচ কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের বৃহত্তম অর্গানাইজেশন হওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত সংকটে আমেরিকান অস্থির। বিশৃঙ্খলা, হাজার মানুষের লম্বা লাইন, মরুভূমির মাঝখানে পরিত্যক্ত শিশু, নদী পেরুতে গিয়ে আন্ডার কারেন্টে মায়ের হাত থেকে ছিটকে পড়ে শিশুদের তলিয়ে যাওয়া, মেয়ে শিশু রেপ, সিরিয়াল কিলারের হাতে খুন, এসব ঘটনা সীমান্তের নিয়মিত সংবাদ। গত দেড় বছরে ১২০০ মাইগ্র্যান্ট খুন হয়েছে ক্রিমিন্যালদের হাতে। ১ লাখ ৭০ হাজার শিশুর কোনো অভিভাবক নেই। ৫ মাস থেকে ১ বছরের এই শিশুরা কীভাবে, কোথা থেকে, কার সঙ্গে এলো, তার তথ্যানুসন্ধান নেই। ড্রাগ স্মাগলার, খুনি, রেপিস্ট, মানবপাচারকারী, চোর, ডাকাত, জঙ্গি, অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট, সব একসঙ্গে মিলেমিশে সীমান্ত পেরিয়ে মহাবিশৃঙ্খলা সৃৃষ্টি করে প্রবেশ করছে স্বাধীনভাবে। কারণ সীমান্তে বৈধ কাগজপত্র দেখানোর প্রয়োজন নেই। ওদিকে মার্কিন সীমান্তে এই ব্যাপক জনজোয়ারের কারণ জানার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণার ধারা এখনো অব্যাহত। সরকার দুবছরেও ৭০ লাখ মানুষের সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় প্রবেশের ‘জড়ড়ঃ ঈধঁংব’ খুঁজে পায়নি। কিন্তু বিশ্বের মানুষের অজানা নেই, মার্কিন সরকার ওপেন বর্ডার পলিসিতে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ঈইচ এজেন্সিকে যখন ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে তাদের আহ্বান জানিয়েছে, তখন এই অবিশ্বাস্য সুযোগকে কোনোমতেই হেলায় হারানো চলবে না। বিশ্বের ধনীতম দেশে আরো বেশি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য, আরো ব্যাপক উপভোগের জন্য, আরো বেশি ব্যক্তিসাফল্যের নিশ্চয়তা পেতে যে কোনো মূল্যে যক্তরাষ্ট্রে পৌঁছতে হবে। কাজেই বলাবাহুল্য, কোনো দরিদ্র দীন-দুঃখীরা নয়, সচ্ছল পরিবারের লাখ লাখ মানুষই কোয়ালিটি অব লাইফের আশায় দুর্বার গতিতে আমেরিকায় ঢুকছে। তাদের অভিনন্দন জানিয়ে দেশজুড়ে স্যাংকচুয়্যারি সিটির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। অস্থায়ী আবাসের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। হোটেলে রাখার কাজও চলছে অব্যাহত গতিতে। সীমান্তের রিপোর্টও জানাচ্ছে, গড়ে রোজ ৬ হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে। এই সংখ্যা দুবছর আগে থেকে চারগুণ বেশি। হিসাব অনুযায়ী শুধু ২০২২-এর জুলাই মাসেই এসেছে ২,৩৫,৪৭৮ জন অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট। তবে এদের সবাই যে সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এসেছে, তা নয়। ২০২১ থেকে ২০২২-এর আগস্ট অবধি ২৫ হাজারের বেশি বিপজ্জনক ক্রিমিন্যাল (জেল পালানো খুনি, কুখ্যাত টেরোরিস্ট, সিরিয়াল কিলার, আদম ব্যবসায়ী) এবং ৮১ হাজারের মতো অন্যান্য অপরাধী (যাদের এর আগে সীমান্ত থেকে বিতাড়ন করা হয়েছিল) পুনরায় ফিরে এসেছে আমেরিকায়। অথচ ঈইচ কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয়ের বৃহত্তম সংস্থা। এমপ্লয়ির সংখ্যা ষাট হাজারের ওপর। যার এক-তৃতীয়াংশই বিভিন্ন পোস্টে বর্ডার প্যাট্রোলিংয়ের কাজে নিযুক্ত। ওদিকে অপরাধীদের জেলখানার বাইরে রাখার পলিসি নেয়ায় দেশীয় ক্রিমিনালদের অপরাধের মাত্রা যেমন বেড়েছে, তেমনি অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের দ্বারা পথেঘাটে, দোকানপাটে অদ্ভুত সব ক্রাইমের ঘটনাও এখন রোজকার নতুন স্বাভাবিক চিত্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সীমান্তে দেয়াল তোলার কাজ বন্ধ করলেও নিজের প্রাসাদতুল্য বাড়ির চারপাশে দেয়াল তুলে পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট এমনিতেও নিরাপদ দেশের ঋইও (ঋবফবৎধষ ইঁৎবধঁ ড়ভ ওহাবংঃরমধঃরড়হ) এবং মিডিয়ার প্রসন্ন দৃষ্টির কল্যাণে। প্রিন্ট থেকে ইলেকট্রনিক, সব মিডিয়াতেই বিরামহীন প্রচার- সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনা নেই। কেননা সীমান্ত উন্মুক্ত নয়। বর্ডার প্যাট্রোলিং সর্বদাই কঠোরতম অবস্থানে। কিন্তু সীমান্তে কর্মরত অফিসাররা বলছেন- বিশৃঙ্খলা এতটাই বেশি, জনজোয়ারের প্রবলতা এতই ব্যাপক যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। অনুগতহীন সংবাদকর্মীরাও দেখাচ্ছেন, সীমান্তের বিরামহীন জনস্রোতের দৃশ্য। সাধারণ মানুষের ট্যাক্স বাড়িয়ে অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ভরণপোষণ করানো ছাড়াও সেলফোন দেয়া হচ্ছে। প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করে ওয়েলকাম জানানো হচ্ছে গভীর আন্তরিকতায়। দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষগুলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অস্থির। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাটের মালিকরা লুটেরা খুনিদের ভয়ে তটস্ত। খুনখারাবি, শুটিং, শিশুহরণ, গাড়ি চুরির নৈমিত্তিক ঘটনায় জনগণ আতঙ্কিত। কিন্তু তবুও সীমান্ত বন্ধ রাখার বিন্দুমাত্র তৎপরতা নেই। ওদিকে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বাঁধিয়ে। সে যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালা হচ্ছে। গ্যাসের মূল্য নাগালের বাইরে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়ছেই। এর ওপর মানুষকে আরো বেশি চাপে রাখতে ওজঝ-এ (ওহঃবৎহধষ জবাবহঁব ঝবৎারপব) যোগ করা হচ্ছে ট্যাক্স এনফোর্সমেন্ট নামে ৮৭০০০ সশস্ত্র এজেন্ট। এদের ৭৫ ভাগ পেমেন্টই হবে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। এখন তাই বহু মুখেই উচ্চারিত আতঙ্কের সেই শব্দগুলো- উবসড়পৎধঃং নববঢ় ঁঢ় ঃধী বহভড়ৎপবসবহঃ, ষবঃ রসসরমৎধঃরড়হ বহভড়ৎপবসবহঃ ষধহমঁরংয! ডেমোক্র্যাটরা ইমিগ্রেশন সংস্থাকে ঠুঁটো বানিয়ে ট্যাক্স আদায়কারী এজেন্সিকে বলশালী করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে! প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্যাট্রিক জে বুকানন ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘ঞযব ফবধঃয ড়ভ ঃযব ডবংঃ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন- ‘ঞযব ডবংঃ রং ফুরহম. ঈড়ষষধঢ়ংরহম নরৎঃয ৎধঃবং রহ ঊঁৎড়ঢ়ব ধহফ ট.ঝ, পড়ঁঢ়ষবফ রিঃয ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ বীঢ়ষড়ংরড়হং রহ অভৎরপধ, অংরধ ধহফ খধঃরহ অসবৎরপধ ধৎব ংবঃ ঃড় পধঁংব পধঃধপষুংসরপ ংযরভঃং রহ ড়িৎষফ ঢ়ড়বিৎ, ধং ঁহপযবপশবফ রসসরমৎধঃরড়হ ধহফ ঢ়ড়ষধৎরুবং বাবৎু বিংঃবৎহ ংড়পরবঃু ধহফ হধঃরড়হ’. প্যাট উপসংহার টেনেছিলেন এই বলে, যারা ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে জনমানুষের বৈচিত্র্য দেখে উল্লাসভরে ‘গোল্ডেন ইয়ার’ উদযাপন করছেন, একদিন ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড আমেরিকার’ ভয়ংকর পরিণতিটা তারা ভালোভাবেই সমঝাবেন। ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা হয়তো এর নামকরণ করবেন- ‘ঞযব ঝঁরপরফব ঞধনষবঃ ড়ভ ঃযব ডবংঃ’! বর্তমান সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে যেভাবে সীমান্ত উন্মুক্ত রেখে আমেরিকাকে বিপন্ন করে তুলছে, তাতে মনে হচ্ছে, মিস্টার বুকানন বর্ণিত ‘ঝঁরপরফব ঞধনষবঃ’ ইতোমধ্যেই গলাধঃকরণ করে ফেলেছে আমেরিকা।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App