×

মুক্তচিন্তা

আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বর্তমান হালচাল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৭:০৩ এএম

আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বর্তমান হালচাল
বাঙালির জীবনে আগস্ট মাস শোকের, হতাশার ও শক্তি সঞ্চয়ে শপথের মাস। আমরা শোক পালনের পাশাপাশি শপথও গ্রহণ করি ভবিষ্যতের যে কোনো কলঙ্কজনক ঘটনাকে রুখে দেয়ার। ১৯৭১, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে আমরা খুনিদের ধিক্কার জানিয়ে ও যারা এখনো বিচারের আওতায় আসেনি তাদের বিচার দাবি করে ক্ষান্ত হই না, ওই খুনিদের আদর্শিক বংশধরদের বিষয়েও সতর্ক হওয়ার প্রস্তুতি নিই। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে মুছে ফেলার বিস্তর চেষ্টা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আমাদের মনে হয়েছিল যে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র বুঝি পৃথিবী থেকে বিদায় নিল, কিন্তু তা হয়নি। ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, পূর্ব ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট শাসকের পতন ঘটেছে; কিন্তু কমিউনিজম পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য কোনো অগ্রসর চিন্তা নিঃশেষ হতে পারে না। ঠিক একইভাবে বাঙালি ও মানুষের মঙ্গলের জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ভাবনা তা নিঃশেষ হওয়ার নয়। আওয়ামী লীগ এবার ৩ মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। ১৯৭৫-এর পরে খুনিরা কখনো ভাবেনি যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারে। তাদের এই ভাবনার মুখে ছাই দিয়ে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পরই খুনি ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়। বজলুল হুদাকে নিয়ে আসা হয় থাইল্যান্ড থেকে। ধীরে ধীরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। ২০০৮-এর পর ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয় এবং এখনো তা চলমান। এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি তা তারা পূরণ করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে নিন্দুকরা অনেক হাসি-তামাশা করলেও মানুষ নিশ্চয়ই এখন সব অনুধাবন করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে আশাতীত। মানুষের মাথাপিছু আয় এবং জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। রাষ্ট্রের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে উন্নয়ন চোখে পড়ে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো আগামী ১০০ বছরের উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়ন করা, যাকে ডেল্টা প্ল্যান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অতীতে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সম্পূর্ণ এডহক ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি। বঙ্গবন্ধু স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, অতঃপর শেখ হাসিনা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলেন। সড়ক, নৌ, আকাশ ও রেল সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও যন্ত্রপাতির অভাবে গবেষণাকর্ম সম্পাদন এক সময়ে কঠিন ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য দুর্ভিক্ষকে পরাজিত করেছে। গতানুগতিক চাকরি ছাড়া কেউ যদি কাজ করতে চায় তাহলে দেশে প্রচুর কাজ রয়েছে। দেশে গৃহ সহায়কের কাজ করার মানুষের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ যে আর আগের মতো অভাবগ্রস্ত নয় এটি তারই ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু খুনিদের অনুসারীরা কি এই উন্নয়ন দেখে তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ রাখবে? আর খুনিদের মোকাবিলা করার পথই বা কি? এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের খাঁটি মানুষ তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু অগ্রসর হয়েছি তা অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন জরুরি। কারণ উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞানের বিকাশ একটি আবশ্যকীয় বিষয়। এই জ্ঞান শুধুমাত্র ডিগ্রি অর্জন করা নয়; ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, শুদ্ধ-অশুদ্ধ বিষয়গুলোর পার্থক্য অনুধাবন করাও জ্ঞান চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বত্র যেন টাকা কামানোর এক মহোৎসব। এ জন্যই বোধ হয় শ্রেয়বোধের মারাত্মক এক নিদারুণ সংকট বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা এই শ্রেয়বোধের অভাব দেখতে পাই। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি এখনো পৃথিবীতে বহাল। অথচ আমরা দাবি করছি যে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশও জ্ঞান চর্চায় এগিয়ে গেছে; কিন্তু শ্রেয়বোধের জায়গায় বোধ হয় পিছিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা শ্রেয়বোধ বা ঔচিত্যবোধকে জাগ্রত করতে পারছে না। এখন বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে মাদ্রাসা নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই মাদ্রাসায় পড়া ছেলেমেয়েরা ভালো আরবি জানেন না; এমনকি কুরআন-হাদিসের শ্রেয়বোধ সংক্রান্ত নির্দেশনা বিষয়েও আশানুরূপ জ্ঞান রাখেন না। এই জ্ঞানের অভাবের কারণেই তারা বেশিরভাগ উগ্রবাদে জড়িয়ে যায়। সমাজে যারা শ্রেয়বোধের চর্চা করেন, যারা ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন তারা কেউ কেউ বিভিন্নভাবে সমাজে নিগৃহীত হচ্ছেন। কিছুদিন আগে নড়াইল এবং ইতোপূর্বে ভোলা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামের প্রতি কটূক্তির প্রতিবাদে শত শত মানুষের বাড়িঘর ভস্মীভূত করা হয়েছে। সরকারি দপ্তরের কাগজপত্রের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এতে ইসলাম ধর্মের কোনো লাভ হয়নি। বরং অন্য ধর্মাবলম্বীদের কছে এই ধর্ম সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে। এই উগ্রতা প্রদর্শনের পরিবর্তে যদি অনুসন্ধান করা যেত যে সত্যিকার অর্থে কার ফেসবুক আইডি থেকে এই লেখাটি ছড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে ফন্দিবাজ ধরা পড়ত। এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়েই ভুয়া আইডি তৈরি করে অপপ্রচারগুলো করা হয়। কিন্তু এসব ঘটনার কোনোটারই এই নাগাদ বিচার সম্পন্ন হয়নি। ফলে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। ইদানীং বেশ কিছু জায়গায় শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। এর অধিকাংশই প্রভাবশালীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এদের মধ্যে জনপ্রতিনিধিও আছেন। যারা এই অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা বঙ্গবন্ধুকে জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ সম্পর্কে জানার জন্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’টি পড়া জরুরি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বেশিরভাগ সংসদ সদস্য বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই পড়েননি। অথচ সবাই বঙ্গবন্ধুর নামেই বক্তৃতা শুরু করেন। তাদের অনুসারী অনেক ছাত্র নেতার অবস্থা আরো ভয়াবহ। তাদের চাঁদাবাজিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ। প্রতিটি সিট বিক্রি হয় কমপক্ষে ৮ হাজার টাকায়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো তাদের দখলেই আছে। হলের প্রভোস্টদের সদিচ্ছা থাকলেও তারা পরিস্থিতির কাছে জিম্মি। বিগত ১৪ বছরে এই যুব সমাজের ওপরে কোনো কাজ হয়নি। আদর্শের প্রচার বা আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা যায়নি। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা বাঙালিত্ব সম্পর্কে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ইসলামের মূল মর্মবাণীর সঙ্গে যে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালিত্বর মতো বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক নয় তা আমরা বোঝাতে ও শেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ শিক্ষকদের কথা কানে নেয়ার সময় তাদের নেই। শিক্ষকদের জন্য ক্লাসরুমও এখন নিরাপদ নয়। কারণ মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ সংকুচিত। সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত রূপ জঙ্গিবাদ। আর জঙ্গিবাদ মানেই হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডও জঙ্গিবাদীদের কাজ। কারণ এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা দেশকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে গেছে। চারদিকে তাকালে বাংলাদেশকে চেনা যায় না। উচ্চ আদালত প্রকাশ্য স্থানে পোশাক পরা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে অনেকের উচ্ছ¡াসের শেষ নেই। কিন্তু ক্লাস রুম ও পরীক্ষার হলে অথবা পরিচয়ের প্রয়োজনের সময়ে পুরো মুখোমণ্ডল আবৃত থাকলে কী হবে এবং আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির পোশাক কী সে বিষয়ে মাননীয় আদালত কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি বা মন্তব্যও করেননি। সমাজ থেকে ক্রমশ নৈতিকতা অপসৃয়মান। অথচ লেবাসধারীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের সঙ্গে লেবাসের কোনো সম্পর্ক নেই। আত্মিক পরিশুদ্ধতাই ধর্মের মূল কথা। বিগত বছরগুলোতে সাংস্কৃতিক খাতে সরকার বিপুল বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু চেতনার জায়গায় কাজ হয়েছে কম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে দেশে নানা রকমের গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। সে ধরনের লক্ষণ আবার শুরু হয়েছে এবং এগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করছে সরকারের দু-একজন মন্ত্রীর কথাবার্তা ও কিছু অসময়োচিত সিদ্ধান্ত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় হাজারবার অস্বীকার করলেও তার বক্তব্য প্রথম যা মিডিয়ায় এসেছে মানুষ সেটিকেই গ্রহণ করছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করলেন তা পুষিয়ে ওঠা কঠিন হবে। এখনো সব নেতিবাচক বিষয়ের দায়ভার শুধু একজন শেখ হাসিনাকেই নিতে হয়। একটা বিষয় আমাদেরকে সর্বদা পীড়া দেয়, তাহল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে তাঁর মন্ত্রিসভার অনেকেই মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা সব মোশতাকের লোক হয়ে যায়। চারদিকে স্তুতির যে বন্যা, তাতে বারংবার সেই ‘মোশতাক’ আতঙ্কই সামনে চলে আসে। সম্প্রতি একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকায় সম্পাদকীয় হয়েছে যে, প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করে না এমন লোকজন বসে আছে। সম্ভবত স্তুতির জোরে সেখানে পদায়ন হয়েছে। আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি বৈকি! মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App