×

মুক্তচিন্তা

কূটনীতির রকমফের

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৬ এএম

কূটনীতির রকমফের

জন্মাষ্টমী উপলক্ষে গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ কর্তৃক চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। দুদেশের স্থিতিশীলতার জন্য শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তা করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অকূটনৈতিক বক্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে নানা দিক থেকে তাকে সমালোচনা ও নিন্দার মুখোমুখি হতে হয়। ইতোপূর্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতকে জড়িয়ে খামখেয়ালিপূর্ণ ও আনাড়ি বক্তব্যে দুদেশের সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ‘আজকাল’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা ওই পত্রিকার ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১২ আগস্ট সিলেটে এম এ জি ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কিত মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ‘বেহেশতে’ আছে বলে সমালোচিত হন। ২৮-২৯ মে ভারতের গুয়াহাটিতে নদী সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে দেশে এসে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যাপারে ভারতের কাছে পরামর্শ চাওয়ার বিষয়টি সাংবদিকদের কাছে প্রকাশ্যে বলে দেন। এপ্রিলের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে র‌্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের দেয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে মার্কিন প্রশাসনকে অনুরোধ করা জন্য ভারত ও আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়দের সাহায্য চাওয়ার বিষয়টিও সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন। তার বক্তব্যগুলো সমকালীন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ১৯ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় জন্মাষ্টমী মিছিলের প্রাক্কালে পলাশী মোড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চট্টগ্রামে দেয়া বক্তব্যকে নাকচ করে বলেন, ‘এটি সরকারের বক্তব্য নয়, এটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অভিমত।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান ২০ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী দলের কেউ নন। তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগের বিব্রত হওয়ার কারণ নেই।’ আবদুর রহমান দলের কেউ নয় বললেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সিলেট-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এ সম্পর্কিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কাউকে কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে পৃথিবীর কোনো দেশ থেকে সাহায্য নিতে হবে। এটি কোনোভাবে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সরকারের বক্তব্য নয়।’ বোঝা যাচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দলীয়ভাবেও তার বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হচ্ছেন। ভারতকে জড়িয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্যের কারণে একদিকে দুদেশের সরকারকে যেমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর হাতে সমালোচনার হাতিয়ারও তুলে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ব্যাখ্যাও দাবি করা হয়েছে। সাবেক কূটনীতিক ও বিশিষ্টজনদের মতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দেশের জন্য মর্যাদাহানিকর ও লজ্জাজনক এবং তার বক্তব্য জাতিকে অপমানিত করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি কূটনৈতিক দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার একটি মণ্ডপে মূর্তির ওপর পবিত্র কুরআন রাখার অভিযোগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫ জন লোক নিহত হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে-বিদেশে বিষয়টি নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার শিকার হন। তার পদত্যাগের দাবিতে সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ করে। চট্টগ্রামের জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে চেরাগী পাহাড় মোড়ে ‘বিক্ষুব্ধ সনাতনী সমাজ’-এর ব্যানারে হিন্দু সম্প্রদায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ভারতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও ২০ আগস্ট ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় জন্মাষ্টমী উৎসবের সমাপ্তি দিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ভারতীয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সম্প্রীতির মূল্যবোধের প্রশংসা করে বলেন, ‘ভারত মনে করে একটি নৃশংস ও গণহত্যাকারী নিপীড়কদের মুখোমুখি লড়াই করে আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও মানবিক বিপর্যয়ের মতো এক অনন্য পরিস্থিতিতে গড়ে ওঠা দুদেশের বন্ধন আরো দৃঢ় হবে। হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্যের অংশীদার দুটি স্বাধীন, সমকক্ষ ও সার্বভৌম দেশ সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বৈচিত্র্যতা ও অন্তর্ভুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। উভয় দেশই অনুধাবন করে ন্যায্যতা, সহানুভূতি ও সবার জন্য সমান সুযোগের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের জাতীয় অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান ও অভিন্ন স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। উভয় দেশের প্রতিটি পদক্ষেপ এরূপ বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে নেয়া হয়, যাতে দুদেশের জনগণের কল্যাণ হবে এবং যা দুদেশের অংশীদারিত্বকে অধিকতর গভীর করবে। ভারত সবসময় বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু হয়ে থাকবে। শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ প্রতিবেশী এবং একটি আন্তঃসংযুক্ত উপ-অঞ্চল নিশ্চিত করতে দুদেশের জন্য একে অপরের সহযোগিতা অপরিহার্য। ভারত সব দেশের সমান অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। ভারতের সব সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। একইভাবে ভারতও বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের কাছ থেকে বন্ধুত্ব আশা করে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতকে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্য দুদেশের সরকার ও জনগণকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললেও ভারতীয় হাইকমিশনারের বক্তব্য দুদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়কে স্পষ্টীকরণ করবে। দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ পারস্পরিক অগ্রগতিতে সহযোগী বা পরিপূরকের ভূমিকা রাখতে পারে। একটি স্বাধীন দেশ বা তার সরকার কখনো অন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এর দফা (১) এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশন অনুচ্ছেদ ১১৯-এর দফা (খ) অনুসারে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন এবং রাষ্ট্রপতি অনুচ্ছেদ ৫৬-এর দফা (৩) অনুসারে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিবেন। বাংলাদেশে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে হাইকমিশনারের বক্তব্যকে পরোক্ষে ভারত সরকারের অভিমত হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সাহায্য চেয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

মিলন কান্তি দত্ত : কলাম লেখক ও সমাজকর্মী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App