×

মুক্তচিন্তা

শোকাবহ আগস্টের অনুভূতি ও ভবিষ্যৎ করণীয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২২, ০১:৪৮ এএম

আগামীকাল আগস্ট মাসের শেষ দিন। শোকাবহ আগস্ট এ বছরের জন্য বিদায় নিচ্ছে, কিন্তু শোক আমাদের জাতীয় জীবন থেকে কতটা বিদায় নেবে সেটি কেউ বলতে পারবে না। অনেকে হয়তো আগস্ট মাস বিদায় নিলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, কারণ আগস্ট মাসের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো তাদের কাছে খুব একটা ভালো লাগেনি; সেটি তারা শুনতে চায় না। প্রায়ই আগস্ট মাসজুড়ে তাদের ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট সম্পর্কে নীরবতা পালন করতে দেখা যায়। জাতীয় জীবনের এত বড় বিয়োগান্তক ঘটনা তাদের মনের মধ্যে তেমন কোনো রেখাপাত তৈরি করে না, এটি কষ্টের বিষয়। কেউ কেউ ১৫ আগস্ট নকল জন্মদিন তৈরি করে কেক কাটার উৎসব করেছে। ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় এখন ‘জন্মদিন পালন’ বিশেষভাবে করে না হয়তো; কিন্তু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের অভিঘাত বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতিসহ সর্বত্র যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করতে কখনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। এখনো তারা যেসব ব্যাখ্যা ও বক্তব্য উপস্থাপন করে তা যেমন যুক্তিগ্রাহ্য নয়, তাতে বিকৃত রাজনৈতিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে একই শক্তি যেসব বক্তব্য প্রদান করে তাও একেবারেই তাদের দায়িত্বহীনতার চূড়ান্ত মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়। বোঝাই যাচ্ছে এরা আগস্ট মাসে কিছুটা মুখ লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে পাছে যদি মানুষ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার জন্য তাদের দায়ী করে ফেলে। সে কারণে তারা রাজনৈতিকভাবেই শুধু নয় যখন ক্ষমতায় থাকে তখন রাষ্ট্রশক্তিকে ও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান করার যেমন অপচেষ্টা করে তেমনি পাঠ্যপুস্তকেও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য কতিপয় দুষ্কৃতকারী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সেনা কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখিয়ে থাকে। ২০০১ সালের পর নিষ্ঠুরভাবে পাঠ্যপুস্তকে লেখা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল তৈরি করার কারণে মানুষ তার ওপর বিক্ষুব্ধ হয়েছিল সেটিরই প্রকাশ ঘটেছিল ১৫ আগস্টের ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যমে! আরো নানা অপব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যেখানে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে নৈরাজ্যকর এবং গণতন্ত্র হত্যার শাসন কাল হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে একজন ব্যর্থ প্রশাসক হিসেবেও কয়েকটি স্কুল পাঠ্যপুস্তকে দেখানো হয়েছিল। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেউ শোক পালনের জন্য উদ্যোগ নিলেও তাদের বাধা দেয়া হতো, তাদের অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয়া হতো। গণমাধ্যমে ১৫ আগস্ট নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ও লেখালেখি প্রশাসন থেকে ভালো চোখে দেখা হতো না। এ তো গেল ১৯৯১-এ গণতন্ত্র উত্তরণের সময়কালের কথা। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৫ আগস্টকে সম্পূর্ণরূপে সরকারিভাবে উপেক্ষা করা হতো। ফ্রিডম পার্টি ১৫ আগস্টের ঘাতক ও তাদের সমর্থকদের দ্বারা দেশব্যাপী শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাধা দিত। সুতরাং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে সামরিক সরকার এবং নির্বাচিত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষার প্রবণতা বিদ্যমান ছিল। শুধু ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা এবং পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেবার দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ ১৫ আগস্ট সকালে কালো ব্যাজ ধারণ করে ১৫ আগস্টের হত্যার প্রতিবাদে মিছিল সহকারে নির্ধারিত স্থানে সমবেত হয়েছিল। শিশুরা ওইদিন বেদিমূলে ফুল দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিল; কিন্তু সে বছরই ১৫ আগস্টে সর্বপ্রথম বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের নজিরবিহীন উদগ্র উৎসব পালন করতে দেখা গিয়েছিল। সেখান থেকেই স্পষ্ট হয়েছে ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের ফলে কারা রাজনীতির সুবিধাভোগী? সমর্থক এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জন্ম নিয়েছে কারা? তাদের কাছেই ১৫ আগস্ট শোকাবহ দিবস না হয়ে বানানো ‘জন্মদিন’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরাই ২০০১ সালের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ থেকে আওয়ামী লীগ, সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উৎখাতে আগ্রাসী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। গোটা দেশে তখন এক নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি হয়। ১৫ আগস্ট তখন কাউকে পালন করতে দেয়া হয়নি। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিকৃত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে ছড়িয়ে দিয়েছিল, রাজনীতি ও গণমাধ্যমেও সেই বিকৃত ইতিহাস সদম্ভে প্রচার করেছিল। অবশেষে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ১৫ আগস্টের অনুরূপ আরেকটি নিষ্ঠুরতর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়েছিল। সেখানেই সবাই দেখেছে প্রকাশ্য দিবালোকে আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল। ফলে ঘাতকরা শুধু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সন্তুষ্ট না থেকে ২১ আগস্ট আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিল। সে কারণে আগস্ট মাস জাতীয় জীবনে পর্বতসম শোকাবহ ঘটনায় পাথর হিসেবে আবির্ভূত হয়। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, নিকটজন, রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের নিশ্চিহ্ন করার নীল নকশা হিসেবে এ দুই হত্যাকাণ্ড দিবস একই অপশক্তির হাতে সংঘটিত হয়। যারা এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল তারা প্রতি বছরই দুদিনের হত্যাকাণ্ডকে একইভাবে অস্বীকার করে আসছে যে, তারা ওই হত্যাকাণ্ডের কিছুই জানত না। এবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন যে, ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বেঁচে যাওয়াই প্রমাণ করে যে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। রিজভী সাহেব এবার যে বাক্য বোমাটির বিস্ফোরণ করেছেন তা হলো- ‘একুশে আগস্টের হামলা আওয়ামী লীগের মাস্টারপ্ল্যান’। দেশের আদালত কর্তৃক প্রমাণিত হওয়ার পরও বিএনপির মতো এত বড় রাজনৈতিক দলের যুগ্ম মহাসচিব যখন একুশে আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এমন নির্লজ্জ মিথ্যাচার করার সাহস দেখান তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে আগস্টের শোকাবহ কোনো ঘটনাই দল হিসেবে বিএনপির কাছে সামান্যতম সমবেদনা পাওয়ার স্থানে নেই। বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী তাদের দলের সিনিয়র এ নেতার বক্তব্যে বিব্রত বোধ করেনি, তাদের নীরবতা রিজভীর বক্তব্যের প্রতি সায় দেয়। যা দল হিসেবে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে বাকি রাখে না। বিএনপি মুখে স্বীকার না করলেও শোকাবহ আগস্টের সব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে নতুবা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদান করেছে। একইভাবে ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে দল এবং তাদের সরকার কীভাবে যুক্ত ছিল, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর যেভাবে সবকিছুকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়; তারা সরাসরি আগস্টের দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে জড়িত ছিল। প্রথমটিতে তারা রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছে এবং হত্যাকারীদের বিচার থেকে দায়মুক্তি দিয়ে বিদেশে চাকরি প্রদান, দেশে আসা ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করেছে। হত্যাকাণ্ডের অনুসারী দল হিসেবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের মতাদর্শগত অবস্থান প্রদর্শন করেছে সে কারণেই আগস্টব্যাপী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এবং এর জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো আগস্টের শোকাবহ ঘটনা নিয়ে নিশ্চুপ থাকে। আবার কখনো কখনো উল্টাপাল্টা কথা বলে, মিথ্যাচার করে, হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোনো শক্তি কখনো রাজনীতিতে স্থান করে নিতে পারেনি। একইভাবে জাতির পিতা এবং তার পরিবার ও অনুসারীদের একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কোনো দেশেই কেউ রাজনীতিতে স্থান করে নেয়ার অবস্থানে নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের কোনোভাবেই গ্রহণ করার কোনো উদাহরণও নেই। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অনেকেই রাজনীতি করেছে, দলগতভাবে সংঘটিত হয়েছে, নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছে। ১৫ ও ২১ আগস্টের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা দল ও ব্যক্তিদের রাজনীতিতে পরিহার করার মানসিকতা তৈরিতে যথাযথভাবে কাজ হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে এদের কউকেই শোকাবহ ঘটনাবলির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে শোনা যায় না, তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেও দেখা যায় না। বাংলাদেশে রক্তাক্ত ১৫ ও ২১ আগস্টের ভয়াবহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মতো কিছু ঘটেছে এমনটি নিয়েও এসব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতে দেখা যায় না। অথচ এই দুটি হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করেছে, গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্যুত করেছে, একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার প্রবল ইচ্ছাশক্তিও এদের অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতায় তাদের অবস্থানকালে সেটির প্রমাণ পুরোপুরি বহন করে। ফলে ১৫ আগস্টের এমন দিবসটি আমরা জাতীয়ভাবে পালন করার নজির এখনো পর্যন্ত দেখিনি, ২১ আগস্ট তো নয়ই। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমাদের রাজনীতির মনন, বিশ্বাস ও সচেতনতা কোথায় অবস্থান করছে? স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি পরস্পরবিরোধী দুটি অবস্থান- একদিকে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের আদর্শের রাজনীতি; অন্যদিকে মুখে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু বাস্তবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতকালে শোক পালন, বক্তৃতা ও আলোচনার আয়োজন করে থাকে কিন্তু জাতীয় জীবনে শোকাবহ আগস্টের অপশক্তির চেহারা উন্মোচন কিংবা তাদের জনগণের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য যে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা গোটা শাসনকাল শুধু নয় বিরোধী দলে থাকাকালীন যে ধরনের দৃঢ়তা, সচেতনতা, সাংগঠনিক তৎপরতা, রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা থাকা দরকার ছিল সেটিও সবসময় দেখাতে পারছে না। আগস্টের পর শোকাবহ আগস্ট নিয়ে আর যেন তেমন কোনো কর্মতৎপরতা থাকে না! অথচ শোকাবহ আগস্টের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা এবং জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির পরস্পরবিরোধী অবস্থানের দৃশ্য। সেই সত্যের উন্মোচন করাটি হোক এবারের শোকাবহ আগস্টের শেষ দিনের প্রতিজ্ঞা। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App