×

মুক্তচিন্তা

জাতীয়তার উপাদান ভাষাই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২২, ০১:৪৮ এএম

গান কে না পছন্দ করে। রুচি বা পছন্দের ভিন্নতার পরও সব শ্রেণির মানুষই গান শুনতে ভালোবাসে। সব রকম গান সবার ভালো নাও লাগতে পারে। প্রত্যেকের ভালোলাগার রকমফের নিশ্চয় আছে। বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়র বলেছিলেন, ‘যে গান পছন্দ করে না, সে মানুষও খুন করতে পারে।’ গানকে হৃদয়বান সব মানুষই নিশ্চয় ভালোবাসে। সে কারণেই গানের চাহিদা অফুরন্ত, চাহিদার যেন শেষ নেই। একটি জাতির সাংস্কৃতিক মান নির্ধারণে সাহিত্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিষয়কেও বিবেচনায় নেয়া হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামেও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অসামান্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের ভূখণ্ডে এযাবৎ সংঘটিত সব আন্দোলন-সংগ্রামকে কেন্দ্র করে অজস্র গান, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছে। জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। সাংস্কৃতিক অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় গান সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এর দ্রুত প্রসার ঘটে। গান কেবল ব্যক্তিগত ভাবাবেগে সীমাবদ্ধ নয়। গানের বহুমাত্রিক আবেদন ও ভূমিকা রয়েছে। প্রত্যেক দেশেরই রয়েছে পৃথক পৃথক জাতীয় সংগীত, রণ সংগীত, দেশাত্মবোধক দেশপ্রেমের গান। জাতীয় পর্যায়েও গানের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের সঙ্গে মিশে আছে লোকসংগীত। অঞ্চলভেদে লোকসংগীতের নানা রকমফের রয়েছে। রয়েছে নানা নামের বিভাজনও। ধর্মাশ্রয়ী আধ্যাত্মিক, মরমি, মুর্শিদি, বাউল, কীর্তন, ভজন, শরিয়তি, মারফতিসহ অনেক ধরনের গান। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুল প্রসাদ, ডিএল রায়, লালন, হাছনরাজা প্রমুখের গানও আমাদের গানের ভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করেছে। শহরের উচ্চ-মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আধুনিক গানের প্রতি অধিক অনুরক্ত। তাই আধুনিক গানের ব্যাপকতা সর্বাধিক দৃশ্যমান। রেডিও, টিভি, চলচ্চিত্র সর্বত্র আধুনিক গানের আধিক্য। প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত গান যে পছন্দের ক্ষেত্রে সর্বজনীন, সেটা সত্য নয়। প্রচারযন্ত্রগুলোর পাঁচমিশালি অনুষ্ঠানের ফাঁকে গানের অনুষ্ঠান হয়, তবে সে গান সবার নিকট পছন্দের গান রূপে বিবেচিত হয় না। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এখন মানুষ পছন্দের শিল্পীর পছন্দের গান ইউটিউবে সার্চ দিয়ে সহজেই শুনতে পারে, এমনকি দেখতেও পারে। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট যুক্ত থাকায় ইউটিউব ব্যবহারে আর কোন বাধা নেই। এক সময়ে চলচ্চিত্রই ছিল বিনোদনের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যম। চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানগুলোই মানুষের পছন্দের তালিকায় ছিল। এখন তো চলচ্চিত্র শিল্পের ক্রান্তিকাল। মানুষ প্রেক্ষাগৃহ এক প্রকার ত্যাগ করেছে। চলচ্চিত্রের দর্শক আকালের প্রধান কারণই হচ্ছে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক অতিমাত্রার মুনাফার লোভ-লিপ্সায়। স্থূল রুচিহীন চলচ্চিত্রের কারণে দর্শক ছবি দেখা অনেক পূর্বেই ত্যাগ করেছে। অথচ এক সময় সুস্থ বিনোদনের অপ্রতিদ্ব›দ্বী মাধ্যম চলচ্চিত্র নির্ভর ছিল সিংহভাগ মানুষ। সেসব জনপ্রিয় ছবির গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে গত শতাব্দীর ষাটের দশকজুড়ে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। স্বাধীনতার পর ক্রমান্বয়ে সে স্বর্ণযুগের অবসানে চলচ্চিত্র শিল্প এখন ম্রিয়মান। লাহোরের উর্দু ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল। অথচ প্রতিযোগীহীন সময়ে চলচ্চিত্র শিল্প দাঁড়াতেই পারল না, মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মুম্বাই-দক্ষিণের চলচ্চিত্রের রিমেক নির্মাণের পাশাপাশি হালের হিন্দি গানের বেগবান স্রোতে বাংলা গানের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলা গানের কথা ও সুর হারিয়ে গেছে। সমৃদ্ধ বাংলা গানের স্বতন্ত্রও টিকে থাকেনি। বাংলা গানের চাহিদা-কদরও সেখানে আর নেই। হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বাংলা সংস্কৃতি হিন্দির একচ্ছত্র দখলদারিত্বে। গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠান জি-বাংলা ‘সারেগামাপা’ নামক গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে। জি-বাংলায় সম্প্রচারিত সারেগামাপা রিয়েলিটি শো’টি আমাদের দেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অডিশনের মাধ্যমে শত শত প্রতিযোগীর মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে ২৫ জনকে নির্বাচিত করে; এই ২৫ জনকেই চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করা হয়। মঞ্চসজ্জা হতে সামগ্রিক ভাবে অনুষ্ঠানটি অঢেল অর্থ-শ্রমে সাজানো হয়। সঙ্গে চমৎকার উপস্থাপনা অনুষ্ঠানটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। উপস্থাপক সকল কথাই বাংলায় বলে থাকেন। কলকাতার চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক-সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের ক্ষেত্রে সাধারণত এটি দেখা যায় না। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারসহ হরেক বাংলা টিভির অনুষ্ঠানে তারা মাতৃভাষার পরিবর্তে হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন। যেন তারা বাঙালি নন। বাংলা ভাষাই জানে না। অথচ কথা বলছে বাংলা চ্যানেলে এবং বাঙালি দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্যেই। সারেগামাপা গানের প্রতিযোগিতায় পাঁচজন বিচারক। অবাঙালি হিন্দিভাষী সংগীত শিল্পীরা ইংরেজি এবং হিন্দিতে বিচারকরূপে কথা বলেন। এদের মধ্যে বাঙালিও আছেন। বাঙালি বিচারক শিল্পীদের সংগীত জীবন বাংলা গান দিয়ে শুরু হলেও বাংলা গানে প্রতিষ্ঠা পাবার পরই পূর্বসূরিদের অনুকরণে তারা আর বাংলা গানে থাকেননি। ছুটে গেছেন মুম্বাইতে। সর্বভারতীয় প্রচার, প্রতিষ্ঠা, পার্থিব প্রাপ্তির আকর্ষণে। তাদের পশ্চাৎপট যে বাংলা গানে ছিল সেটাও তারা বেমালুম ভুলে গেছেন। বিচারক হিসেবে তাদের কথা বাংলার পাশাপাশি হিন্দি-ইংরেজির মিশেল দিতে ভুল করেন না। বাংলা ভাষা ভারতের অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার সমমর্যাদায় আঞ্চলিক ভাষা রূপে স্বীকৃত। হিন্দি তাদের সরকারি ভাষা। ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি এবং ক্ষমতার বলয়ে থাকা শাসকশ্রেণি এককেন্দ্রিক শাসনের বৃত্তে বৃহৎ ভারতকে কেন্দ্র করে পুঁজিপতিদের বিশাল বাজার সৃষ্টি করেছে, পরাধীন আমল থেকে আজ অবধি। পাশাপাশি শাসকশ্রেণি বৃহৎ ভারত শাসনের সুযোগ হাতিয়ে নিয়েছে; অজস্র জাতিসত্তার মানুষদের নিখিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আফিম গিলিয়ে। জাতীয়তা বলতে তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদই বোঝে। মাতৃভাষাভিত্তিক জাতীয়তা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের চাররাজ্য তামিলনাড়–, কেরালা, অন্ধ্র, কর্নাটক ব্যতিক্রম। চার রাজ্যের পৃথক চার ভাষা তামিল, মালায়ালম, তেলেগু, কানাড়া পরিত্যাগ করে তারা হিন্দির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়নি। বরং হিন্দির অনুপ্রবেশ তারা শক্ত হাতে রুখে দিয়েছে। দক্ষিণের ওই চার জাতি নিজেদের মাতৃভাষার বিকল্প ভাষারূপে সরকারি ভাষা হিন্দিকে নয়, ইংরেজিকে বেছে নিয়েছে। সারেগামাপা অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীরা সত্তর থেকে আশি ভাগ হিন্দি গান গেয়ে থাকে। অবশিষ্ট বিশ ভাগ বাংলা, শাস্ত্রীয়, ধর্মাশ্রিত বাউল, লোকসংগীত-কীর্তন ইত্যাদি। হিন্দি গানের প্রতিই বিচারকদের পরোক্ষ পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়। হিন্দি গানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগীদের যে পরিমাণ নাম্বার দেয়া হয়, বাংলা গানের ক্ষেত্রে তুচ্ছতাচ্ছিল্যে কম নাম্বার প্রদানে প্রতিযোগীদের নিরুৎসাহিত করা হয়। এতে প্রতিযোগীরা বাধ্য হয়েছে হিন্দি গানের অভিমুখে ঝুঁকতে। পশ্চিম বাংলা, আসামসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রতিযোগীদের তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রতিভা-শৈল্পিক সক্ষমতা প্রকাশ করতে হয়। নিঃসন্দেহে অসামান্য চমৎকার এই অনুষ্ঠানটি। প্রতিযোগীরা বয়সে সবাই তরুণ-তরুণী। গানের তাল, লয়, সুরের ওপর তাদের প্রত্যেকের অসামান্য দখল। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। প্রতিযোগীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে হয়। বিজয়ের মুকুট একজনের মাথায় তো উঠবেই। নব্বই ভাগ প্রতিযোগী বিভিন্ন জেলা থেকে আগত। শহর কলকাতার তরুণ-তরুণীরা জেলার থেকে সাংস্কৃতিকভাবে যে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এই অনুষ্ঠানের প্রতিযোগীদের উপস্থিতি সেটা প্রমাণিত হয়। তবে জি-বাংলা চ্যানেলের এই গানের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানটি যদি বাংলা ভাষাভিত্তিক হত, তাহলে আমরা বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পীদের জনপ্রিয় গানগুলো শোনার সুযোগ পেতাম। কিন্তু সে গুড়ে বালি। চ্যানেলের নাম জি-বাংলা হলেও মালিকানা তো আর বাঙালিদের নয়। অনিবার্যভাবে অবাঙালি হিন্দি বলয়ের পুঁজিপতি কিংবা বহুজাতিক বণিক সম্প্রদায়ের। বাঙালিদের ব্যবসা-বাণিজ্যে, অর্থ-বিত্তে নগণ্য অংশকেই দেখা যায়। বাঙালিরা একটা সরকারি দপ্তরে কেরানির চাকরি পেলেই বর্তে যায়। তাদের চাওয়া ঐটুকুতেই সীমিত। পশ্চিম বাংলার অর্থনীতি-রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও বাঙালিদের হাতে নেই। সমস্তই লোপাট হয়েছে হিন্দিভাষী-বণিকদের অধীনে। সংখ্যাধিক্য বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ। যারা হিন্দি ভাষাকে ফেরি করে কলকাতায় বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। বাঙালিদের হিন্দি প্রীতিতে বাংলা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মড়ক লেগেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলা ভাষার ন্যায় বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্র তাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। আগামীতে পারবে সেটাও অনুমান করা যায় না। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App