×

জাতীয়

জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২২, ০৮:১১ এএম

জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন!

ছবি: ভোরের কাগজ

জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জনগণের কথা সরকারের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না। জনগণ তাদের চাওয়া পাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরার উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় তৃণমূল কতটা গুরুত্ব পায়, এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট মহলের। স্থানীয় সরকারের চারটি স্তর- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ সঠিকভাবে কাজ করছে না বলে মনে করছেন অনেকেই। এক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, স্থানীয় সরকার বিকাশের পথে আমলাতন্ত্র বিরাট বাধা। সাম্প্রতিক সময়ে আমলাতন্ত্র ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। কোভিড মোকাবিলা থেকে শুরু করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিব শতবর্ষে’ জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে আমলাদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এসব কারণে জনপ্রতিনিধিরা আরো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। বিশ্লেষকদের মতে, আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য যেমন রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্ন থাকাও রাজনীতির জন্য অন্ধকার দিক।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন অনুযায়ী যে কাজগুলো স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানসমূহের করার কথা, তা আদৌ করা হচ্ছে কি না, তা-ও সরকার কখনো দেখে না। তা ছাড়া কাজগুলো করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক সামর্থ্য গড়ে তোলার কোনো পদক্ষেপও কখনো নেয়া হয়নি। সম্প্রতি রাজধানীতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত নাগরিক সম্মেলনে সিপিডি পরিচালিত ‘জাতীয় উন্নয়নে অঙ্গীকার : শিক্ষা, শোভন কর্মসংস্থান, জেন্ডার সমতা’ শীর্ষক প্রকল্পের ফলাফল তুলে ধরা হয়। সিপিডি জানায়, জনগণ তাদের চাওয়া পাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরার উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধিদের কাছে জনগণ তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারলেও নির্বাচনের পর সে সুযোগ কমে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির প্রক্রিয়ায়ও জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, তৃণমূলের জন্য তৃণমূলের সরকার থাকবে; স্থানীয় সরকার। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছেন না। করার ইচ্ছেও তাদের মধ্যে দেখছি না। এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের প্রতিষ্ঠান। জনগণের স্বার্থ তুলে ধরার জন্য। কিন্তু তারা তা করছেন না। কাজে লাগাচ্ছেন না। আর মানুষও ভাবছে না এসব নিয়ে। কারণ মানুষ জানে তাদের কথা কেউ শুনবে না। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের স্তর- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জেলা পরিষদ ও সংসদ সঠিকভাবে কাজ করছে না- এটি ঢালাওভাবে বলা উচিত হবে না। কোথাও কোথাও করছে। কোথাও কোথাও না। কিন্তু কাজের সঠিক রূপরেখা জনগণ জানে না। রাজনৈতিক দলগুলো জনবিচ্ছিন্ন।

দলের ভেতরে গণতন্ত্র নেই। দলগুলো মালিক-শ্রমিকের মতো চলছে। দলের ভেতরেই তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কর্মীদের কথা, নেতাদের কথা শুনে না, তাহলে জনগণের কথা আর কে শুনবে?

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কী বলছেন : ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, এই পরিষদের জন্য নির্ধারিত কাজ প্রায় ১১০টি। এর মধ্যে রয়েছে এক বছর ও পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করা। এ ছাড়া ইউনিয়নের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখা, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, খাল-নদী-জলাশয় রক্ষা, দখল-দূষণ রোধ, নারী উন্নয়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, শিক্ষা বিস্তার, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, বিচার-সালিশ, সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, তার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিষদের পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রভৃতি। তবে বাস্তবে হাতে গোনা কয়েকটি কাজ যেমন- কাবিখা, কাবিটার আওতায় কিছু অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন; পরিষদের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ, জন্মমৃত্যু নিবন্ধন, প্রত্যয়নপত্র দেয়া, কিছু আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বিচার-সালিশ করে থাকেন তারা। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ইচ্ছে সত্ত্বেও দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় না মন্তব্য করে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কাজল চন্দ্র তালুকদার ভোরের কাগজকে বলেন, স্থানীয় সরকারের ভিত্তি হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন করা। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব বেশি দিচ্ছি আমরা। আমাদের প্রথম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। তহবিল কম। আমাদের সবগুলো দায়িত্ব পালনের ইচ্ছেই থাকে। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে সব দায়িত্ব পালন করতে পারি না।

এদিকে উপজেলা পরিষদের জন্য ৩১টি কাজ আইনগতভাবে নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু বাস্তবে এই পরিষদের কাজ খুবই সীমিত। জানতে চাইলে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলু ভোরের কাগজকে বলেন, স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। স্থানীয় সরকারের যে ধাপগুলো রয়েছে সেই কাঠামোগুলোতে জেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ কাজ করতে পারে। কিন্তু উপজেলা পরিষদ অনেকটাই অকার্যকর। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সংবিধানে যা উল্লেখ রয়েছে এবং বর্তমান সরকারের যে বিধান রয়েছে, সেগুলো যদি মানা যায়, তাহলে আমরা আমাদের পর্যায়ে থেকে কাজ করতে পারব। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমরা কাজ করতে পারছি না। আমরা এসব নিরসনে বিধান চেয়েছি।

এছাড়া জেলা পরিষদ (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া) জন্য নির্ধারিত কাজ রয়েছে ৬৩টি। কিন্তু উপজেলা পরিষদের মতো তারাও এডিপিভুক্ত কিছু উন্নয়নকাজ ছাড়া দৃশ্যমান আর কোনো কাজ করে না। জেলা পরিষদের এই কাজও দৃশ্যমান হয়েছে প্রশাসক নিয়োগের পর থেকে। পৌরসভার জন্য আইনে নির্ধারিত কাজের সংখ্যা ১৭২টি। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা, রাস্তার বাতি ঠিকঠাক রাখা, নতুন রাস্তা তৈরি এবং পুরনো রাস্তা মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণসহ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন, নর্দমা পরিষ্কার, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন ও কিছু প্রত্যয়নপত্র দেয়া, টিআর-কাবিখা বিতরণের মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ।

প্রয়োজন জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সেতুবন্ধন : জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন মন্তব্য করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় স্থানীয় সরকার একেবারেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। যদিও আমাদের সংবিধানে বিপরীত ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত। ক্ষমতাসীনদের আউটপোস্ট হিসেবে পরিণত হয়েছে।

জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন নন, বরং শেখ হাসিনার নির্দেশে সবাই জনগণের পাশে রয়েছে- এমন বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, জাতীয় দুর্যোগ থেকে শুরু করে বৈশ্বিক সংকট কোভিডেও আওয়ামী লীগ মাঠে ছিল। জনগণের পাশে ছিল। দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ত্রাণ, খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে জনগণের পাশে ছিল। এখনো আওয়ামী লীগ জনগণের পাশে রয়েছে। এ ব্যাপারে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ভোরের কাগজকে বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তৃণমূলের অংশগ্রহণ বা গুরুত্ব তেমন উল্লেখযোগ্য নয়- একথা আমাদের স্বীকার করতে হবে। তবে, আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি তৃণমূল। আওয়ামী লীগ সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্নভাবে তৃণমূলের মতামত নেয় এবং তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে। তৃণমূলের কথাগুলো মূল্যায়ন করা হয় বলেই বাঙালির আপন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের পথে এগিয়ে চলছে।

এদিকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের জন্য জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সেতুবন্ধন প্রয়োজন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, রাষ্ট্র কাঠামো এখনো আমলাতান্ত্রিক। আমলাতন্ত্র তার স্বার্থেই চায় না স্থানীয় সরকার যথাযথভাবে বিকশিত হোক। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে হচ্ছে স্থানীয় সরকারের ব্যাপারে কম গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং আমলাতন্ত্রের ওপর ক্রমাগতভাবে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, গণমাধমের ভূমিকাও এখানে বড় ফ্যাক্টর। মিডিয়া অনেক সময় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি মানেই দুর্নীতিবাজ- এটি প্রচারেই বেশি ব্যস্ত। এটি প্রচার হবে অবশ্যই, কিন্তু সরকারি অফিসে আদৌ কোনো দুর্নীতি আছে কি না- এ ব্যাপারে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন খুব কম। তৃণমূল পর্যায়ে একজন জনপ্রতিনিধির কাছে টাকা পৌঁছানোও তো আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেই হয়। রাজনীতিবিদ মাত্রই দুর্নীতিবাজ, এটি আমাদের মাইন্ড সেট হয়ে গেছে। এভাবে পুরো রাজনীতিই কালিমালিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জনপ্রতিনিধির কোনো দুর্নীতি হলে তার দায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেবে। কিন্তু আমলাতন্ত্র এবং জনপ্রতিনিধিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একপক্ষকে ড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত বলে তাকে উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত নয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App