×

মুক্তচিন্তা

নারীর নিরাপত্তা ও হালের বাংলাদেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২২, ০১:০৩ এএম

ইদানীং নারীর নিরাপত্তা ও বাংলাদেশ যেন দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরে অবস্থান করছে। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই রোজই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নারী অপহরণ, নারীকে বিবস্ত্র করা, তাকে নানাবিধ দৈহিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা এতই বেশি যে, তা দেখতে দেখতে সেগুলো যেন সবারই গা-সহা হয়ে গেছে। তাই প্রতিবাদের ভাষাও অত্যন্ত সীমিত-প্রতিরোধ প্রচেষ্টাও দৃশ্যত অস্তিত্বহীন। আমি সামাজিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা বলছি। বাংলাদেশের বিপুল উন্নয়নের কথা আমরা হামেশাই শুনছি। উন্নয়ন অবশ্য হচ্ছেও। বিশাল মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু নিজেদের তহবিলে নির্মাণ করে মাত্র দেড় মাস আগে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন দেশের উন্নয়নের এক অনস্বীকার্য নজির। পদ্মা সেতু ছাড়াও আরো অনেক প্রকল্প কার্যকর করা হয়েছে- নির্মাণাধীনও রয়েছে বহু প্রকল্প। বাংলাদেশে এখন আর খড়ের ঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। টিনের ঘর গ্রামে-গঞ্জে হাজারে হাজারে দৃশ্যমান। বহু দালানকোঠা উঠেছে- চোখ ধাঁধানো বহু বাজার-বিপণী, বহুতল বিশিষ্ট দালানকোঠা, ফ্ল্যাট ইত্যকার গড়ে উঠেছে। ব্যক্তিমালিকাধীন প্রাইভেট কার যেন ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত অসংখ্য যানবাহনের তুলনায় সংখ্যাগত দিক দিয়ে কম নয়। এ জাতীয় আরো অনেক কথা তুলে ধরা যেতে পারে। তবে উন্নয়নের আরো একটি দিকও রয়ে গেছে যে দিকটি সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকা অপরাধ। এ জাতীয় চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতির রেকর্ড প্রমাণ প্রসার ঘটেছে। সম্পদ জাতির মালিকানায় নয়- বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার কোটিপতি ছিল এবং তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল ব্যাপক গণআন্দোলন। আজ বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা হাজারেরও বেশি এবং এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ব্যাংকের পর ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা অনবরত পাচার হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো মিন মিন করে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হলেও তার কোনো বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিরিয়ে আনার কথাগুলো স্তোকবাক্য মাত্র- তা এ সংক্রান্ত দীর্ঘ ইতিহাসই সন্দেহাতীভাবে প্রমাণ করে। অপর ব্যাংকগুলো ও অপরাপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপির সংখ্যা রীতিমতো উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে উঠেছে। বাড়ছে অব্যাহত গতিতে কিন্তু তা পরিশোধের কোনো লক্ষণ নেই- নেই ন্যূনতম উদ্যোগও। উল্টো ঋণখেলাপিদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন সরকারিভাবে দেখানো হলেও খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা তাতে আদৌ সাড়া দিচ্ছেন না- উল্টো খেলাপি ঋণের অঙ্কের পরিমাণ প্রতি বছরই লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপ্রতিহত গতিতে। অপরদিকে ঋণখেলাপি হওয়া বা ঋণের টাকা পরিশোধ করা রীতিমতো একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের তরফ থেকে বিশেষ একটা মামলাও দায়ের করা হচ্ছে না, কারণ সম্ভবত এই যে যারা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন তারা সরকারঘেঁষা কেউকেটা। তাই তাদের গায়ে হাত দেয়ার সাধ্য ব্যাংকেরও নেই- হয়তো বা আইনেরও নেই। পরিণতি দাঁড়াচ্ছে সংকটগ্রস্ত জাতীয় অর্থনীতিতে সংকটের মাত্রা আরো গভীরতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পদ্মা সেতুসহ যেসব মেগা প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন ঋণখেলাপির সংখ্যা, বিদেশে অর্থ পাচারকারীর সংখ্যা ও অপরাপর অপরাধে অপরাধীদের সংখ্যাও দিব্যি স্ফীত হচ্ছে। অপরাপর অপরাধ যেমন বিদেশে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে হাজার হাজার, লাখ লাখ কোটি টাকা দিব্যি নিরাপদে পাচার, লুটপাট, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রভৃতিও অবাধে চলছে। কোনো অপরাধীর কোনো শাস্তি নেই। সুতরাং সব অপরাধীই নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে একের পর এক অপরাধ করেই চলেছে ক্লান্তিহীনভাবে। এরই মুখে আজ সর্বাধিক ভয়াবহ রূপ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজের নানা স্তরে আবির্ভূত হয়েছে যৌন অপরাধ। নারী দেহ আজ এক শ্রেণির পুরুষের কাছে সীমাহীন লোভের শিকারে পরিণত হয়েছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা। এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছে যেমন নারী সংগঠনগুলো, তেমনই তা ছিল সব গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকামী দল ও সংগঠনের অন্যতম প্রধান দাবি। এই দাবি পাকিস্তান আমল থেকেই ক্রমেই জোরদার হতে হতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের নারী সমাজও রাইফেল হাতে নিয়ে পাকিস্তান সেনা ও তাদের এ দেশীয় লেজুড়দের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেছেন। এসব কিছুর পরিণতিতে নারী সমাজ অতীতের তুলনায় অনেক অধিকারও অর্জন করেছেন। যেমন চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে। এখন নারী হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে, প্রশাসনিক নানা উচ্চপদে যেমন- সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, পুলিশ সুপার, ব্যাংকগুলোর নানা দায়িত্বশীল পদে তারা নিয়োগ পাচ্ছেন। অবশ্য চাকরিতে নারীদের এখন পর্যন্ত স্বীকৃত পদের সংখ্যা ৩০ শতাংশ হলেও প্রশাসনিক ও নানাবিধ টালবাহানায় সেই নিরিখ পর্যন্ত নিয়োগ নারীরা এখনো পাননি। তবু দেশের নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবী এবং তাদের সহকারী পদে, বিভিন্ন অফিস-আদালতে নানাস্তরের কেরানির পদে বেশ ভালোসংখ্যক মহিলা কাজ করে চলেছেন। এ ছাড়া এখন বাজার-বিপণিগুলোয় মোটামুটি বেশ সংখ্যক নারী ঝবষষং এরৎষ হিসেবেও কর্মরত। এভাবে যে হাজার হাজার কর্মরত নারী আমাদের সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন- তার ৯৫ শতাংশই বা তারও বেশি হেঁটে বা রিকশায় বা স্কুটারে বা বাসে চড়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। তাদের সঙ্গে স্বামী, ভাই বা বাবা কেউই থাকেন না- থাকা সম্ভবও নয়। নিজ নিজ অফিসের কাজকর্ম সেরে এদের অনেকেরই ফিরতে সন্ধ্যা বা রাতও হয়ে যায় অনেক সময়। ফলে ফিরতি পথের যাত্রাকালে মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে হয় তাদের। বাসে দেখা যায় চালক, হেলপার এবং এক শ্রেণির পুরুষ যাত্রীর লোলুপ দৃষ্টি, কেউ বা সুযোগ পেলে নারী দেহের স্পর্শকাতর কোনো অঙ্গ স্পর্শ করে বা যাত্রীহীন অবস্থায় পেলে বিবস্ত্র করা ও ধর্ষণ, গণধর্ষণ করার কাহিনী এখন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রায় নিয়মিতই স্থান পাচ্ছে। খবরগুলোই যেন আতঙ্কের সৃষ্টি করে। আরো ভয়াবহ অনেক খবরের মুখোমুখি সংবাদপত্রের পাঠকদের প্রায়ই হতে হয়। যেমন মাদ্রাসা শিক্ষক তার নাবালক ছাত্রীকে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তার সহপাঠিনীকে, শিক্ষক তার ছাত্রীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করছেন। এমনকি কোনো কোনো শিক্ষিকা তার ছাত্রকে বাসায় ভিন্ন কথা বলে ডেকে এনে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে ছাত্রটিকে শেষ পর্যন্ত তাতে বাধ্য করার কাহিনীও প্রকাশ হতে দেখা যায়। এছাড়া অফিস-আদালতে কর্মরত নারী সমাজের কাউকে কাউকে পুরুষ সহকর্মী বা তাদের উচ্চতর কর্মকর্তা দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার কাহিনীও একেবারে কম নয়। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য চাকরির নিরাপত্তা, সমাজের চোখে হেয় হওয়ার আশঙ্কাজনিত কারণে প্রায় ৯৮ শতাংশ ঘটনাই ভুক্তভোগী হন। ফলে অপরাধীদের শাস্তি বা তাদের বিচারও সব কিছুর আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু এর ফলে ভুক্তভোগী নারীরা একাধিক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য হন। যেমন যৌন লালসাগ্রস্ত ওই কর্মকর্তারা বা পুরুষ সহকর্মীরা প্রায়ই দেহ উপভোগে লিপ্ত হতে পারেন- কিন্তু বিষয়গুলো গোপন না রেখে চাকরির বা আর্থিক নিরাপত্তা হারানোর আশঙ্কা থাকে। এছাড়া অধিকতর মারাত্মক যা হতে পারে এবং হয়ও কখনো কখনো, ভুক্তভোগী নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়তে পারেন। শেষোক্ত ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীদের বিয়ের ক্ষেত্রে আর বিবাহিতদের স্বামী ও অন্যদের আস্থা হারিয়ে তাদের অজানা ভবিষ্যতের যাত্রীতে পরিণত হতেও হতে পারে ঘর-সংসার পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে। সন্তান থাকলে এ ক্ষেত্রে সমস্যা সংকট আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। কাজেই নারী জীবনের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারটি একদিকে যেমন জটিল, অন্যদিকে তেমনই তার জন্য উপযুুক্ত উদ্যোগও এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। আদালতের মনোভাব কঠোর হলেও বিচার প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ায় মামলা চলাকালীন পথে-ঘাটে নিগৃহীত হতে হয় অনেক ভুক্তভোগী মেয়েকেই। এগুলো প্রতিরোধে আদালতকে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়তার জন্য সিআরপিসির প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে বিচার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করা অপরপক্ষে আমাদের পরিবার, শিক্ষায়তন, কর্মস্থল, রিকশা, স্কুটার, বাস প্রভৃতির চালকদের নৈতিক শিক্ষা এবং তার প্রয়োগে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। মনে রাখা প্রয়োজন, যত দিন না আমরা জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব- তত দিন আমরা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্বের মর্যাদাও দাবি করতে পারব না।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App