×

জাতীয়

‘নিষিদ্ধ’ বাম্পার গাড়িতে বহাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২২, ০৮:২৪ এএম

‘নিষিদ্ধ’ বাম্পার গাড়িতে বহাল

বহাল তবিয়তে চলছে ‘নিষিদ্ধ’ বাম্পার গাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

গাড়ির সামনের ও পেছনের বাম্পারে আটকে গিয়ে একাধিক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এরপর পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে যানবাহনের সব বাম্পার খুলে ফেলার নির্দেশনা দেয়া হলেও তা পুররোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো রাজধানীসহ সারাদেশে ৯০ শতাংশ প্রাইভেটকার, ট্রাক, পিকআপে বাম্পার বহাল তবিয়তে আছে। এসব বাম্পার খুলে ফেলতে বারবার সময় বেঁধে দেয়া দেয়া হলেও সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। ঢাকার রাস্তায় যানজট নিরসনে ব্যস্ত সময় পার করার কারণে বাম্পার খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পুলিশেরও কোনো মাথাব্যথা নেই।

জানা গেছে, ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম রাজধানীতে বাস ও ট্রাকে বাম্পার সংযোজন শুরু হয়। ২০০০ সালের দিকে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য গাড়ির সামনে ও পেছনে অতিরিক্ত বাম্পার সংযোজন শুরু হয়। এরপর থেকে এখনো বাম্পার লাগানোর এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাইভেট কারের পেছনের বাম্পারে জড়িয়ে একের পর এক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ হতাহত হতে থাকলে প্রাইভেট কারের পেছনের এই বাম্পার এক সময় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। এই বাম্পারে বিভিন্নভাবে আটকে প্রায়ই প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় প্রাইভেট কারের পেছনের বাম্পারে জড়িয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়। এর আগেও কলাবাগান সিগন্যালে একজন ডাক্তার তার স্ত্রীকে মোটরসাইকেলে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি প্রাইভেটকারের পিছনের বাম্পারে ডাক্তারের স্ত্রীর পা আটকে যায়। প্রাইভেট কারটি দ্রুতগতিতে যেতে থাকে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গাড়িটি ট্রাফিক সিগন্যালে আটকা পড়লে চালক পালিয়ে যায়। ডাক্তারের স্ত্রীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনার পর গাড়ির সামনের ও পেছনের বাম্পার খুলে ফেলার দাবি জোরদার হয়। ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ধলাগাছ মোড়ে মোমেনা খাতুন (৪৫) নামে এক শিক্ষিকা রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি প্রাইভেট কারের বাম্পারে আটকে যান। প্রাইভেট কারটি মোমেনা খাতুনকে বেশ কিছুদূর টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। গাড়ির পেছনে অতিরিক্ত বাম্পার সংযুক্ত করা না থাকলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না।

জানা গেছে, উন্নত বিশ্বের কোথাও কোনো ধরনের গাড়িতে অতিরিক্ত বাম্পার ব্যবহারের সুযোগ নেই। উন্নত দেশে এ ধরনের বাম্পার ব্যবহার একবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে গাড়িতে বাম্পার ব্যবহার হচ্ছে।

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে সচিবালয়ে এক সভা হয়। তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক সভায় উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় গাড়িতে অতিরিক্ত বাম্পার ব্যবহার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে গাড়ির বাম্পার খুলে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু কেউ ওই নির্দেশনা মানেনি। পরবর্তীতে সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। এতেও কোনো কাজ হয়নি। দফায় দফায় বৈঠকের পর পরিবহন মালিকদের অনুরোধে তৃতীয় দফায় বাম্পার খুলে ফেলার সময় আবারো বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়। এই নির্দেশনার পর সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনের বাম্পার, হুক ও অ্যাঙ্গেল খুলে নিতে মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এই নির্দেশনার প্রতিফলনও দেখা যায়নি। মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি, বাস-ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশন, প্রাইম মুভার্স ওনার্স এসোসিয়েশন, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারাও বৈঠকের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা করেননি।

পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রাফিক আইনের বিধিতে বলা হয়েছে, গাড়িতে অতিরিক্ত নিরাপত্তার নামে বা সৌন্দর্য বর্ধনের নামে কোনো ‘বাম্পার’ লাগানো যাবে না। অনাকাক্সিক্ষত সংষর্ষে অন্য গাড়ির বেশি ক্ষতি হয় এমন কোনো লোহার অ্যাঙ্গেল বা ধাতব পাত গাড়ির বডিতে ব্যবহার করা যাবে না। এটা ‘খ’ শ্রেণির অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ এর বাইরে বাম্পার লাগানোর ব্যাপারে কোনো কিছু বলা নাই। তবে ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এ বাম্পার থাকা না থাকার বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। একারণে এখন গাড়িতে বাম্পার আছে কি নাই-এ ব্যাপারে পুলিশ কিছুই দেখে না, ব্যবস্থাও নেয় না। তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখন ব্যবস্থা নেয়া হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন্স শাখার ডিসি ফারুক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে একটি দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যানবাহন থেকে বাম্পার খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ তখন তা বাস্তবায়নে কাজ করে। তবে ঢাকার বাস্তবতায় অযান্ত্রিক ও যান্ত্রিক যানবাহন খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে চলাচল করে। এতে প্রায়ই মোটরচালিত গাড়ির গায়ে ঘর্ষণজনিত ক্ষতি ছাড়াও নানা ঘটনা ঘটে। রাস্তায় প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বিবাদে ট্রাফিক পুলিশকে সময় ব্যয় করতে হয়। এসব পরিস্থিতির নিরিখে সময়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে শিথিলতা দেখা দিয়েছে।

অবাধে বাম্পার বিক্রি হচ্ছে : গাড়িতে অতিরিক্ত বাম্পার সংযোগ নিষিদ্ধ হলেও অবাধেই বাম্পার সংযুক্ত করা হচ্ছে। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি ওয়ার্কশপের কর্মচারী শহিদুল ইসলাম জানান, বাম্পার লাগাতে সরকারের নিষেধ আছে কিনা জানা নাই। তারা অনেক বছর ধরেই গাড়িতে বাম্পার লাগাচ্ছেন। ৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা দামের দেশি ও বিদেশি বাম্পার বিক্রি হচ্ছে। মালয়েশিয়া ও চীন থেকেও এখন বাম্পার আমদানি করা হয়। যারা বাম্পার বিক্রি করে তারাই নিজ দায়িত্বে গাড়িতে বাম্পার সংযুক্ত করে দেয়। মোহাম্মদপুর, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, কাওরানবাজার, বাড্ডা, মিরপুর, গাবতলীসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ওয়ার্কশপ থেকে এগুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, গাড়ির সামনে ও পিছনে বাম্পার থাকলে ছোটখাটো আঘাতেও গাড়ির বডির কোনো ক্ষতি হয় না। ভারী অথবা হাল্কা যে কোনো যানবাহনে বাম্পার থাকলে গাড়ি কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাড়ির ডেন্টিং ও পেইন্টিংয়ে খরচ অনেক কম লাগে। তবে অতিরিক্ত বাম্পারের আলাদা ওজন রয়েছে। চেসিসে বাম্পার যুক্ত করলে এই অতিরিক্ত ওজন গাড়িকেই বহন করতে হয়। আর এতে জ্বালানি খরচ বেড়ে যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App