×

জাতীয়

মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২২, ০৮:২৬ এএম

মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় বিএনপি

প্রতীকী ছবি

** রাজপথে এখনই শক্তি ক্ষয় করবে না বিএনপি ** তিন মাসের অলআউট আন্দোলনের প্রস্তুতি ** আগে মাঠ দখল, পরে হরতাল-অবরোধ ** নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার নির্দেশ **

আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপি এখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’। পিছু হটলেই পড়তে হবে অস্তিত্ব সংকটে। তবে এখনই কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে শক্তি ক্ষয় না করে মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করবে দলটি। এর আগে রাজপথে শেষ পর্যন্ত নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে পরিস্থিতি বুঝে কৌশলে পদক্ষেপ নেবে বিএনপি। পাশাপাশি দলের ভাঙন রোধে সরকারের যে কোনো টোপ থেকে ‘সতর্ক’ থাকবেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। গত কয়েক মাস ধরেই বদলে গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’। সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচিতে মামলা-হামলার ভয় উপেক্ষা করে তারা সরব থাকছেন রাজপথে। কেউ বলছেন- ‘ছাড় দেয়ার আর সময় নেই, যেখানেই আঘাত সেখানেই প্রতিরোধ’। কেউবা দিচ্ছেন সরকার পতনের হুঙ্কার। নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছে চলমান কর্মসূচির গতি বাড়িয়ে এমন কঠোর জোরালো কর্মসূচি আসবে যেখানে জনগণের সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হবে। জ¦ালানি তেল, দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে এরই মধ্যে গ্রাম পর্যায়ে বিএনপির লাগাতার বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উন্নয়নের ফাঁকফোকর যখন ফাঁস হচ্ছে, অসহ্য বাজারদর, নিদারুণ লোডশেডিং- এসব নিয়ে মানুষের মনে যখন ক্ষোভ জমেছে, তখন কিনা বিএনপি ভাবছে, এখনই বড় আন্দোলন নয়! তাদের মতে, বিএনপি হয়তো মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করছে। তবে আন্দোলন প্রশ্নে দিনক্ষণ, তারিখ ঠিক করে হয় না। ইস্যুভিত্তিক তাৎক্ষণিক মাঠ গরম করতে না পারলে সেই আন্দোলনে গতি আসে না।

আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের ভাষ্য- এখন হার্ডলাইনে গিয়ে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় আন্দোলনের কর্মসূচি টেনে নেয়া কঠিন। এই মুহূর্তে শক্ত আন্দোলনে গেলে নেতাকর্মীরা হামলায় আহত হবে, মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নাজেহাল হবে। তারা বলছেন, আন্দোলনের উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত ঢালাওভাবে রাজপথে থাকলে হিতে বিপরীত হবে। এর আগে এমন প্রস্তুতি নিতে হবে যেন যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে রাজপথে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা যায়। সরকার নানাভাবে উসকানি দিয়ে বিএনপিকে মাঠে নামাতে চায়। এসব ফাঁদে পা দেয়া ঠিক হবে না।

তাছাড়া চূড়ান্ত আন্দোলনে বেশকিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশি শক্তির পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশগুলোর ভূমিকা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হয়। দেশগুলো যাতে সরকারের ওপর নির্বাচন ও আন্দোলন ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করে। তবে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবকিছু গুছিয়ে এনে সুযোগ বুঝে দেশব্যাপী একযোগে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

দাবি আদায়ে আন্দোলনই শেষ সিদ্ধান্ত কিনা- জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, অবশ্যই কঠোর আন্দোলনের বিকল্প ভাবছি না। আন্দোলন মানেই নড়াচড়া করা। কিন্তু কোনো সরকার যখন জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় তখন কেবল নড়াচড়া নয়; ভূমিকম্প হয়। তিনি বলেন, আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফর্মে আসে। কখনো সেটা প্রতিবাদ সমাবেশ, সমাবেশ কিংবা ধর্মঘট অবরোধের মধ্যে দিয়ে আসে। তাই বিএনপির রুটিন কর্মসূচির বাইরে ধাপে ধাপে সুনির্দিষ্ট এমন কর্মসূচি আসবে যেখানে জনগণের সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততার মধ্যে দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হবে।

ফয়সালা হবে রাজপথে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আন্দোলনের পেক্ষাপট কেমন হবে সেটা এখনই বলার এখতিয়ার আমার নেই। তবে বিএনপির কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি বলে দেয় আমাদের কতটা প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যাবে কোন পথে ফায়সালা হবে রাজপথে’। এই রাজপথ থেকেই অবৈধ সরকারকে ধাক্কা দিতে হবে। আমরা এই স্লোগানেই এগোচ্ছি।

আগে মাঠ দখল, পরে হরতাল-অবরোধ : সূত্র জানায়, রাজপথে অলআউট নামার আগেই আন্দোলনের ওয়ার্মআপ সেরে ফেলতে চায় দলটি। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কী হবে তা নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বিশ্লেষণ চলছে। নেয়া হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের মতামত। এক্ষেত্রে আগে মাঠ দখলের কৌশল নিয়েছে বিএনপি। আগামী বছরের জুন-জুলাই মাসকে টার্গেট করে নেয়া হচ্ছে সরকার পতনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ঢাকা শহরকে মূল কেন্দ্র ধরে সারাদেশে ৩ মাসব্যাপী লাগাতার আন্দোলনের টার্গেট নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি। এই সময় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের চাঙাভাব ধরে রাখতে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের মাঠে রাখা হবে। এর মাধ্যমে সরকারবিরোধী মত সৃষ্টির পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চায় বিএনপি।

পাশাপাশি আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব সাংগঠনিক জেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের লক্ষ্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের মাধ্যমে ৮১টি সাংগঠনিক জেলায় এই বার্তা পাঠানো হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে টিকে থাকতে নতুন নেতৃত্ব আনা হচ্ছে। সারাদেশের নেতাকর্মীরা একযোগে রাস্তায় নামার সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত তৃণমূল নেতাদের প্রেপ্তার এড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি সরকারের ওপর জনমত ও আন্তর্জাতিক মহলের কার্যকর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনকে গতিশীল করার চেষ্টা রয়েছে। কূটনৈতিক মহলের পাশাপাশি তৎপরতা চালানো হচ্ছে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের মধ্যেও। সব কিছুই পরিচালিত হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর দিয়ে। লক্ষ্য হাসিলে টিম গঠনের মাধ্যমে নেতাদের দেয়া হবে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। এ ব্যাপারে একটি নীতিগত অবস্থানে পৌঁছাতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বেশ ঘন ঘন স্থায়ী কমিটির বৈঠক করছেন নেতারা।

পরিবর্তন আসছে কর্মসূচির ধরনে : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি জোটের আন্দোলনে দেশজুড়ে হয় চরম সহিংসতা। হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ। ২০১৫ সালে টানা ৯৩ দিনের টানা হরতালে ফের রাজপথ উত্তাল করে বিএনপি। সে সময়ে আগুন সন্ত্রাসের তকমা লাগে বিএনপির গায়ে। এ জন্য দলের নগর কমিটির নেতাদের দায়ী করে আসছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ফলে গত ৭ বছরে ব্যাপক বদলেছে বিএনপির কর্মসূচির ধরন। দলটি এখন সভা-সমাবেশ, গণঅনশন, মানববন্ধন, স্মারকলিপির মতো কর্মসূচি দিয়ে জনগণকে আস্থায় এনে গণঅভ্যুথানের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম ঘটাতে চায়। ধীরে ধীরে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে চায় তারা। সেক্ষেত্রে হরতাল-অবরোধ অবশ্যই থাকবে; তবে সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে। দলটির নেতারা মনে করেন, বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনের ভুলগুলো আর করা যাবে না। বরং এমন কৌশল নিয়ে রাজপথে নামতে হবে যাতে আন্দোলন মুখ থুবড়ে না পড়ে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, হরতাল না দিলেও আমরা ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে আছি। আন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথ দখলে নিতে পারলেই হরতাল দেয়া হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি বাস্তবমুখী কর্মসূচি নিতে চায়। বর্তমান সরকারকে রাজপথে উৎখাত করা কঠিন কাজ। তাই বিএনপি ধীরে ধীরে এগোতে চায়। নির্বাচনের আগে শক্তি ক্ষয় করতে চায় না। নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি বাকি। হয়তো বিএনপি অপেক্ষায় আছে- এখন শক্তি ক্ষয় না করে নির্বাচন আরো কাছে আসুক, তারপর সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App