×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংকে নয়-ছয় : সঞ্চয় রক্ষার বার্তা জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২২, ১২:৩০ এএম

ব্যক্তি-গ্রাহকের স্থায়ী আমানতের সুদ ৩ মাসের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হতে পারবে না- গত বছর জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশটি অনেকের বিস্মৃত হয়ে গেছে। কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশ মেনেছে কিনা, তা পরখের গরজও নেই অনেকের। নিষ্ঠুর বাস্তবতায় সরকারের মধ্যেও চেপে যাওয়ার ছাপ। আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নির্দেশ কার্যকর না করলে বা ব্যর্থ হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা প্রমাণ নিয়ে প্রশ্ন করেও কূলকিনারা মেলে না। সাধারণ মানুষের অর্থনীতি নিয়ে ভাবার ফুরসতও কম। মাইক্রো ইকোনমিক্স নিয়ে টুকটাক ভাবলেও ম্যাক্রো ভাবার সক্ষমতা নেই তাদের। সক্ষম হতেও চায় না। যদ্দুর ভাবে সেটাও করে শোনা কথায় কান দিয়ে। জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয় নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। খাবার, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের দাম ওঠানামার আলোচনাও করে যার যার সামর্থ্য দৃষ্টে। এসবের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেলে চটে, ক্ষেপে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ হয় না। বিক্ষোভে ফেটে পড়ার দিন ফুরিয়ে গেছে বা বাঘে খেয়ে ফেলেছে সেই কবেই। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও তা ভালো করে ওয়াকেবহাল। বেতন বা আয়ে মাস চলে কিনা, এর বাইরে ভাবার অবস্থাও নেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের। এরপরই না ব্যাংকের খবর জানা! ব্যাংকিং সেক্টরে নয়-ছয় সুদহার থাকা না-থাকা নিয়ে বিতর্কের ধুমে শরিকানা নেই দেশের সাধারণ মানুষের। এর চেয়ে জরুরি মানুষের আমানত খেয়ানত না হওয়ার গ্যারান্টি। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে প্রায় সব দেশ। বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য ও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে বেড়েছে খাদ্য, ভোগ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম। জ্বালানি তেলের দাম চড়ায় বেড়ে গেছে পরিবহন খরচও। এতে চাপে পড়েছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির চাপে বিশ্বের প্রায় সব দেশ। তারা মুদ্রা সরবরাহ কমাতে সুদহার বাড়ানোর ওপর ভরসা করছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছে। ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক-ইসিবি বাড়াচ্ছে ধীরগতিতে। বড় অর্থনীতির দেশের মধ্যে কেবল জাপানই শূন্য সুদের হার ধরে রেখেছে। আর ৮০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে অবাক করে দিয়েছে তুরস্ক। সুদের হার না বাড়ানোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এখানে ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশই রেখে দেয়া হয়েছে। আর এই সুযোগ নিয়ে একটি শ্রেণি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিলাসপণ্যের পাহাড় গড়ছে। সুদ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও দেদার ব্যাংক ঋণ নিচ্ছেন। আমানতের চেয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। এক হিসাব বলছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এই এক বছরে ঋণ বাড়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা সুদের হারের সীমা তুলে দেয়ার সুপারিশ করলেও এর সুফল নিয়ে সন্দিহান বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই যদ্দূর সম্ভব চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে সুদহার নয়-ছয় করার সিদ্ধান্তটি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারণা ঋণের সুদহারের সীমা এখনই তুলে দিলে আরো চাপে পড়বে ঋণগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। তা বাড়িয়ে দেবে তাদের উৎপাদন ব্যয়। এরপরও তোলা রয়েছে ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের দেয়া বিলাসপণ্য উৎপাদন ও আমদানি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ এবং গাড়ি, বাড়ি, ব্যক্তিগতসহ বিভিন্ন ভোক্তাঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দেয়ার প্রস্তাবটি। ব্যাংক চেয়ারম্যানদের উদ্যোগ ও সরকারি সিদ্ধান্তে এটি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ২০২০ সালের এপ্রিল করোনার ভয়াবহতার সময় থেকে। এরপর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে মেয়াদি আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। তবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ হলেও ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ রয়ে গেছে। এতে মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রেখে যা পাচ্ছে, তাতে বেড়ে যাওয়া খরচও মিটছে না। পুরো খরচ তো পরের বিষয়। নানা কথামালা ও পরিস্থিতির অনিবার্যতা এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে, এখন আর সুদহার বেঁধে রাখার সুযোগও নেই। মানুষের সঞ্চয়ের সামর্থ্য নেই। কারো কারো সামর্থ্য থাকলেও ভয় তাড়া করছে। এতে ব্যাংকে আগের মতো উদ্বৃত্ত অর্থ নেই। তার ওপর ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ডলার কিনতে হচ্ছে। ডলারের সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার চলে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্টে। আর চলতি অর্থবছরে বিক্রি করেছে প্রায় ১৯০ কোটি ডলার। এতে গত জুলাই ও চলতি আগস্টে ব্যাংক থেকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। তাই সুদহার নির্দিষ্ট করার বদলে এখন বাড়ানোর দিকে যেতে হচ্ছে। সার, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হবে। এর সামগ্রিক আপতন গিয়ে পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর। দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে। কমবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। তখন স্বাভাবিকভাবে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা আরো বাড়ানোর তাগিদ আসবে। এরই মধ্যে সেই কথা উঠে গেছে। বেসরকারি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র শিল্প ব্যবসাগুলোর কী দশা হবে? বেসরকারি চাকরিজীবীদেরই বা কী হবে? এমন দমবন্ধকর অবস্থায় দেশে খেলাপি ঋণে নতুন আরেক রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছাড়িয়ে গেছে সোয়া লাখ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় উত্তরাধিকারসূত্রে খেলাপি ঋণ পেয়েছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। একের পর এক আর্থিক খাত কেলেঙ্কারি এবং ঋণখেলাপিদের বারবার সুযোগ দেয়ার পর সেই খেলাপি বেড়ে তা ঠেকেছে কমছে কম ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়। হিসাব পাকা করলে অঙ্কটি আরো বেশি হবে। বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল করা ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। খেলাপি হয়ে গেছে প্রণোদনা ঋণও। গত জুন শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। উপরোক্ত তথ্যই বলছে, সময়টা এখন খেলাপিদের। যত সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে তারাই। নানা সুবিধা নিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে রাখতে পারছেন, আবার বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করছেন। একে একদম নতুন বলা যায় না। প্রায় সব সরকারই নানাভাবে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিয়ে আসছে। এতে কখনোই দেশে খেলাপি ঋণ কমেনি, বেড়েছে। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়াও তাদের কারো কারো কাছে আভিজাত্য, হিম্মত এমন কি স্মার্টনেসের ব্যাপার। ক্ষমতাবান বলেই এমন ব্যক্তিত্বদের ঋণ পেতে সমস্যা হয় না। বরং তাদের টাকা পাইয়ে দিতে দিওয়ানা ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত। দাতা-গ্রহীতা দুপক্ষের সমঝোতাতেই ঘটছে ঘটনা। কিন্তু কয়েক লাখ বড়জোর কোটি টাকা পেয়ে ব্যবসা করবেন, সুদাসলও ফেরত দেবেন এমন কেউ ঋণ চাইলে কী দশায় পড়েন? জানেন ভুক্তভোগীরাই। কত নিয়ম-কানুন তাদের জন্য! পুরো ব্যাপারটাই একদম ওপেনসিক্রেট। এর কারণ সংশ্লিষ্ট সবারই জানা। এই জানাজানির মাঝেই ১০টি ব্যাংকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংক বলে চিহ্ন দেয়া হয়েছে। শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং প্রভিশনের পরিমাণ বিবেচনায় এই চিহ্নিতকরণ। দুর্বল শনাক্ত করা ১০ ব্যাংকের নাম না জানালেও তা একেবারে গোপন থাকছে না। উপরন্তু ১০টির তালাশ করতে গিয়ে গুঞ্জন-গুজবে মুখে-মুখে উচ্চারিত হয়ে যাচ্ছে ২০-৩০টির নাম। আর বোনাস হিসেবে ভর করেছে টেনশন। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় কিনা, আমানত রাখা টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কিনা এ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা বেড়েছে। আমানতকারীদের উদ্বেগের লাগাম টানতে ব্যাংক বিশেষ করে সরকারের দিক থেকে এর দ্রুত ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App