×

মুক্তচিন্তা

চীন কি তাইওয়ান গিলে খাবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২২, ১২:৩১ এএম

এ প্রশ্নের উত্তরে জোর দিয়ে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলা ঝুঁকিপূর্ণ। পুরো বিষয়টাই নির্ভর করছে প্রথমত চীন, দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রসমূহ এবং তৃতীয়ত তাইওয়ানের জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের চাওয়ার ওপর। ১৯৭১-এর শুরুতে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণেই ছিল এবং মার্চের হত্যাযজ্ঞের পরও, স্বাধীনতা ঘোষিত হলেও বাঙালিদেরই একটি অংশ পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের দালাল আলবদর রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতা অনিবার্য ছিল বলেই স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। তাইওয়ান ১৯৪৯-এর অক্টোবর থেকেই রাজনৈতিক আর্থিক প্রশাসনিক ও সামরিক দিক দিয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে; একদা চীনের অন্তর্গত ছিল বলে চীন কখনো মেইনল্যান্ডের সঙ্গে একীভূত করার দাবি প্রত্যাহার করে নেয়নি। চীন মনে করে তাইওয়ান তাদের ‘পথভ্রষ্ট একটি প্রদেশ’। তাইওয়ানিজ পাবলিক অপিনিয়ন ফাউন্ডেশনের জুন ২০২০-এর একটি বড় ধরনের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে দেশের ৫৪ ভাগ নাগরিক স্বাধীন তাইওয়ানের দাবি সমর্থন করে। ২৩.৪ ভাগ মনে করে বর্তমান অবস্থা অর্থাৎ ‘স্ট্যাটাস কুয়ো’ অব্যাহত থাকুক- কাগজে কলমে ‘না স্বাধীন না পরাধীন’ এমন একটি অবস্থা লাভজনক। ১০ ভাগ নাগরিকের এ বিষয়ে কোনো মতামত নেই অথবা মতামতও প্রদানে অনীহা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ১২.৫ ভাগ মনে করে চীনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে হবে। সেটাই হবে লাভজনক। বহুবার ক্ষমতায় আসা কুয়োমিনটাং রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার দাবি করেনি এবং একসময় তাদেরই দাবি ছিল মেইনল্যান্ড চীন তাদেরই। সুতরাং সেটিকে পুনরুদ্ধার করে তাইওয়ানের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। চীনই হচ্ছে তাইওয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। তাইওয়ানের ৪২ শতাংশেরও বেশি রপ্তানির বাজার হচ্ছে চীন, আর তাদের ১২ শতাংশেরও বেশি আমদানি দ্রব্য আসে চীন থেকে। চীনা কারখানায় তাইওয়ানের ২০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। আবার সেমিকন্ডাক্টর ও আইটি প্রযুক্তির কিছু অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের জন্য চীন তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল। বাস্তবতা হচ্ছে চীন ও তাইওয়ান উভয় দেশের মুখ্য অগ্রাধিকার বাণিজ্য।

চীন বিপ্লব রপ্তানি করে না দু’তিন বছর আগেও চীন পর্যবেক্ষক পণ্ডিতরা বলেছেন অস্ত্র ব্যবহারের মতো হঠকারী ও অবিবেচক কাজ যুক্তরাষ্ট্র করে থাকে, নেহায়েত গায়ে এসে না পড়লে চীন বন্দুক তাক করে না, সীমান্তও ডিঙ্গায় না। চীনের স্বপ্ন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি হবে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে এক নম্বর। এ কারণে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভাবাদর্শ ও বিপ্লব রপ্তানি চীনের এজেন্ডায় নেই। চীনের সেই অর্থনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে কিংবা হয়েছে কিনা তা আর পুরনো প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বব্যাপী পরবর্তী বিশ্বে ২০২২ সালে প্রশ্নের ধারা বদলে গেছে। এখন জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়েছে কি? সিআইএর ফ্যাক্টশিট থেকে কি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব উভয়ে এক বাক্যে স্বীকৃতি দিচ্ছে যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ডিঙ্গিকে যাচ্ছে। ২০০০ সালেও চীনকে বর্ণনা করা হয়েছে একটি দরিদ্র উন্নয়নশীল অর্থনীতি হিসেবে, যে দেশ ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে ঢোকার জন্য প্রাণপাত করে চলেছে। পরবর্তী বাস্তবতা ইউএস স্কেপটিক বা যুক্তরাষ্ট্রের সন্দিহানদের কাছেও অবিশ্বাস্য। * চার দশক ধরে চীন একই ধরনের জাদুকরী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রক্ষা করে চলেছে; সেই প্রবৃদ্ধি গড়পরতা যুক্তরাষ্ট্রের চারগুণ আর চীনের এই অর্থনৈতিক জাগরণ ‘গেøাবাল ইকোনমিক অর্ডার’কে পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে। * ২০০০ সালে চীনের জিডিপি ছিল ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার আর ২০২২ সালে ১৭.৬৭ ট্রিলিয়ন। পারচেজিং পাওয়ার প্যারেটির হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রেকে আগেই ছাড়িয়ে গেছে। * যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে এখন চীনই হচ্ছে পৃথিবীর ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়ার্কশপ। যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে চীনই এখন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ১ নম্বর বাণিজ্যিক অংশীদার। ‘ক্রিটিক্যাল গেøাবাল সাপ্লাই চেইনে’ সবচেয়ে অপরিহার্য লিঙ্ক হয়ে উঠেছে চীন। * ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধির এক-তৃতীয়াংশ ঘটেছে চীনে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দামি গেøাবাল কোম্পানির আবাসস্থল হয়ে উঠেছে চীন। ব্রিটেনকে অপসারণ করে ১৮৭০-এর দশক থেকে যে শীর্ষ অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ধরে রেখেছিল তা হাতছাড়া হয়ে গেছে বলা যায়। ম্যাককিনসে এন্ড কোম্পানির সমীক্ষা ও বিশ্লেষণে ২০২২ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ চীন। দ্বিতীয় স্থানে যুক্তরাষ্ট্র।

নবমিত্র কমিউনিস্ট চীন বৃহৎ মিত্রের সন্ধানে ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূমিকায় এবং অঙুলি হেলান এতদিনকার অবিচ্ছেদ্য মিত্র রিপাবলিক অব চায়না বা তাইওয়ান ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কৃত হলো এবং সেই স্থানটি পূরণের জন্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না- পিআরসি আমন্ত্রিত হলো। তার আগেই ১৯৬৯ থেকেই শুরু হলো রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি বদলের পালা। দুই চীন স্বীকার করা যাবে না। বেছে নিতে হবে লাভজনক চীনকে। তাইওয়ানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রের সংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে এখন ১৩-তে নেমেছে। দেশগুলো হচ্ছে বেলিজ, হেইতি, ভ্যাটিকান সিটি, হন্ডুরাস, মার্শাল আইল্যান্ড, নারাও, পালাও, প্যারাগুয়ে, সেইন্ট কিটস এন্ড নেভিস, সেইন্ট লুসিয়া, সেইন্ট ভিনসেন্ট এন্ড দ্য গ্রেনাডাইনস, টুভালু ও গুয়েতেমালা। এগুলোর ক’টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন দ্বীপরাষ্ট্র। ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সূচকে এগুলোর কোনোটিই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৭১-এ চীন-যুক্তরাষ্ট্র কথোপকথন শুরু হয়, ১৯৭২-এ প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফর করেন; কিন্তু চীনকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যুক্তরাষ্ট্র আরো সময় নেয়। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ১ জানুয়ারি ১৯৭৯ চীন-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

তাইওয়ান কতটা স্বাধীন কতটা সার্বভৌম? যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে অগ্রাহ্য করে এতে ২৫ বছরের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে যখন তাইওয়ানের ভূমি স্পর্শ করলেন একটি বড় যুদ্ধের উসকানি তিনি যে দিলেন এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। একই সঙ্গে চীনের একটি প্রাক-যুদ্ধ দামামা বাজিয়ে তাইওয়ানকে কিছুটা তটস্ত করে তুলল। একজন বৃদ্ধ তাইওয়ানিজ বিশ্লেষক বললেন, গত সত্তর বছর তো এসব ধমক, হুমকি আর আস্ফালনের পুনরাবৃত্তি দেখেই আসছি, সমস্যা নেই। এভাবেই চলবে। এতে দুই চীনেরই মাংসপেশি শক্তি বাড়ছে। কিন্তু ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান যাওয়ার জন্য এত ক্ষেপে উঠেছিলেন কেন? নাকি এটা ছিল ডেমোক্র্যাট ন্যান্সি আর রিপাবলিকান বাইডেনের পাতানো কোনো খেলা- আর পেছন থেকে উভয়কেই খেলিয়েছে ‘মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’। অস্ত্র বিক্রিতে হয়তো আকাক্সিক্ষত ‘কামাই’ হয়নি, করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোসহ যুদ্ধবাজ দেশগুলো বছর দুয়েকের বেশি সময় অন্য দেশের বিরুদ্ধে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার ফুরসত তেমন পায়নি। তাইওয়ানকে সামনে রেখে যদি ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া যায় এটাও যে লক্ষ হতে পারে বিশ্লেষকরা তা মেনে নেবেন। চীনের সতর্কীকরণ উপেক্ষা করে ন্যান্সি এসেছেন। চীনের এক চীন নীতির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে তাত্ত্বিক সমর্থন এই সফর তা নাকচ করে দেয়। ফলে মূল ভূখণ্ড পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার অপদস্ত বোধ করারই কথা। এই অপদস্ত বোধ করার অনুভূতি ‘ক্রিটিক্যাল অ্যানলিস্টদের’ মতে চীনের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগও এনে দিয়েছে। আবার তা যতটা না চীনের, তার চেয়ে বেশি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের। তিনি তৃতীয় দফায় পার্টি প্রধান ও চীনের প্রেসিডেন্ট হতে চাচ্ছেন এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ন্যাশনাল কংগ্রেসও আসন্ন। সুতরাং নিজের অবস্থান সংহত করতে তাকে সাফল্যের তালিকা আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। মূল ভূখণ্ড চীনের যে কোনো নাগরিকের কাছে একটি বড় দেশ দখলে নেয়ার চেয়ে তাইওয়ান দ্বীপকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে পারাটা অনেক বড় সাফল্য। এতে চীনা জাতীয়তাবাদী সমর্থন আরো জোরদার হবে। সুতরাং চীন তাইওয়ানের বিরুদ্ধে তিন ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে : তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একীভূত করতে উভয় দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনমত গঠনের লড়াই চালাবে; মনস্তাত্ত্বিক লড়াই অব্যাহত রাখবে এবং আক্রমণাত্মক সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে যথাসময়ে ঘোষিত যুদ্ধে নেমে যাবে। তাইওয়ানকে ঘিরে বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থানে চীনের সামরিক মহড়া আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। চীনের বিরুদ্ধে জাপানও সাগরে নেমেছে, এতে সংকট বহুমুখী হয়েছে এবং সংকটের মাত্রাও বেড়েছে। বিশ্লেষকরা যুদ্ধের কাউন্টডাউন শুরু করে দিয়েছেন। চীন অর্থনীতির সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মাথাপিছু আয়ের হিসাবে এখনো তাইওয়ানের অনেক পেছনে। ২০২১ সালের হিসাবে চীনে মাথাপিছু আয় ১৪০৯৬ মার্কিন ডলার আর পারসেজিং পাওয়ার প্যারিটিব হিসেবে ২১৩৬ ডলার। একই সময় তাইওয়ানের মাথাপিছু আয় ৩৩৬৪৯ ডলার, আর পারসেজিং পাওয়ার প্যারিটির হিসেবে ৬৮৭৩০ ডলার। আর্থিক সক্ষমতা তাইওয়ানেরও কম নয়। সেই সক্ষমতার সঙ্গে যোগ করা যায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ও সার্বিক সহযোগিতা। কিন্তু চীনের উত্থান, বিশ্বের ১৮২টি রাষ্ট্রের চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক, ১৯৬৯ থেকে ২০২২-এর মধ্যে তাইওয়ানকে স্বীকৃতিদানকারী দেশের সংখ্যা ৬৯ থেকে ১৩-তে নেমে আসা সব মিলিয়ে তাইওয়ানের রাজনৈতিক মর্যাদা আসলে কী? প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত চীনা গণযুদ্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুযুদ্ধের সম্মিলিত ফলাফল তাইওয়ানের মর্যাদা নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের অভ্যন্তরে মেইনল্যান্ড চায়না থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে তাইওয়ান প্রণালির কারণে বিভক্ত দ্বীপ তাইওয়ানে মনুষ্যবাসের ইতিহাস ১২-১৫ হাজার বছর আগেকার। ১৫৯০ সালে পর্তুগিজ নাবিকরা এই দ্বীপে প্রথম অবতরণ করে বলেন ‘ইলহা ফরমোজা’ অর্থাৎ সুন্দর দ্বীপ। সপ্তদশ শতকের শুরুতে চীনাদের আগমন শুরু হয়, একই শতকের মাঝামাঝি সময়ে ডাচ বণিকরা দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৯৬১-তে মিঙ্গ রাজত্ব ডাচদের উৎখাত করে দ্বীপ দখল করে নিলেও দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারেনি, ১৬৮৩-তে তারা পরাস্ত হলে কিঙ্গ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ফ্রান্স ও জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কিঙ্গ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৮৯৪-৯৫-তে চীন-জাপান যুদ্ধে জাপান বিজয়ী হয়ে পুরো তাইওয়ান দখল করে নেয়। জাপানে চাল, চিনি ও কলা সরবরাহের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে তাইওয়ান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের অন্যতম প্রধান সামরিক ঘাঁটি ছিল তাইওয়ান। এখান থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আক্রমণ চালানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানকে পরাজিত ও পর্যদুস্ত করে ফেলে। ১৯৪৫-এ তাইওয়ান চীনের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। মহাযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই চীনে গণযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বে একদিকে জাতীয়তাবাদী শক্তি অন্যদিকে মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে বিপ্লবী কমিউনিস্ট শক্তি। ১৯৪৯ সালে জাতীয়তাবাদীরা পরাস্ত হয়। চিয়াং কাইশেক প্রায় ২০ লাখ সমর্থক নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই তাইওয়ানে পালিয়ে যান এবং সরকার গঠন করেন। রিপাবলিকান ও কমিউনিস্ট উভয়ে মনে করে তাইওয়ান চীনেরই অংশ এবং রিপাবলিকানরা আরো মনে করত তারাই মেইনল্যান্ড চীন দখল করে একীভূত চীন প্রতিষ্ঠা করবে। ঠিক একই দাবি কমিউনিস্টদেরও। কাজেই তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবি উঠেনি দুদিক থেকেই- এক চীন প্রতিষ্ঠার শোর উঠেছে উভয় অংশেই। তাইওয়ান শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন ও স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে, কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন নববন্ধুত্ব তাইওয়ানকে জাতিসংঘ থেকে বহিষ্কার করে দেয় এবং তাইওয়ানের স্বীকৃতিদাতা দেশগুলো স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে কমিউনিস্ট চীনকেই একমাত্র চীন হিসেবে মেনে নেয় এবং ‘এক চীন’ নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। কোনো দেশ তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিক বা প্রদত্ত স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিক তাতে তাইওয়ানের স্ট্যাটাসের তেমন হেরফের হয় না। তাইওয়ান আইনগতভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, কখনোই না- তবে এটাও সত্য ১৯৪৯-এর পর থেকে তার দেশীয় কার্যক্রম ও আন্তর্জাতিক লেনদেন স্বাধীন রাষ্ট্রের অনুরূপই ছিল- এখনো তাই। শুধু তাই নয় এখন তাইওয়ানও চীনকে চরম শিক্ষা দেয়ার হুমকি দিতে শিখেছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App