×

জাতীয়

এনআইডি সংশোধনে ভোগান্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৯ এএম

এনআইডি সংশোধনে ভোগান্তি

বছরের পর বছর ঘুরছেন গ্রাহক

ছবিসহ ভোটার তালিকা করা হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। এখন পর্যন্ত নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ খাতে কোটি কোটি টাকা খরচের পরও ২৫ শতাংশ ভোটার এখনো পাননি পরিচয়পত্র।

যারা পেয়েছেন তাদের অনেকের পরিচয়পত্রে রয়েছে অসঙ্গতি। কিন্তু সংশোধন করতে গেলেই পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। অনলাইনে এনআইডি সংশোধনের ঘোষণা দিলেও তা সব সময় কাজ করছে না। ফলে দিনের পর দিনে ইসির উপজেলা-জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয় ঘুরেও সেবা না পেয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেকেই। এই প্রেক্ষাপটে গত ২৬ জুলাই এনআইডি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে ক্যাটাগরি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩০ দিন সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।

এছাড়া নাগরিকদের হয়রানি কমাতে মাঠপর্যায়ে অযৌক্তিক দলিলাদি চাওয়া থেকে বিরত থাকতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও ভোগান্তি কমেনি। বেশির ভাগ আবেদনই অযথা পাঠানো হচ্ছে প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে অবহেলায় পড়ে থেকে থেকে ফাইলের স্তূপ বেড়ে হচ্ছে পাহাড়সম। আর এসব এনআইডি সংশোধনের জন্য সুদূর গ্রামাঞ্চলের লাখ লাখ গ্রাহক ছুটে আসছেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে, ঘুরছেন দিনের পর দিন। পয়সা দিলে ফাইল নড়ে, নয়তো হদিস মেলে না নথির- এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

এদিকে বিভিন্ন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে ও কয়েকটি উপজেলা নির্বাচনী অফিসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সংশোধনের জন্য জমা পড়া আবেদনের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই নিজ নামের বা বাবা-মায়ের নামের ভুল সংক্রান্ত। ১০ শতাংশ আবেদন ঠিকানা পরিবর্তনজনিত। তবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩০ শতাংশ আবেদন জমা পড়ে জন্ম তারিখের ভুল সংশোধন চেয়ে। কোনো কোনো এনআইডিতে ৬ মাস থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সের ভুলও রয়েছে। আর এই ভুলের কারণে হচ্ছে না পাসপোর্ট। কেউ কেউ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না, কেউ করোনা টিকা নিতে পারছেন না। আবার কারো বিদেশ যাওয়ার টিকেট থাকলেও এনআইডিতে সামান্য ভুলের কারণে ভিসা হচ্ছে না। এমনি নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন দেশের লাখো গ্রাহক।

আছে কিছু উদ্ভট ধরনের ভুলও। যেমন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার হায়দারপুর গ্রামের গৃহবধূ মোছা. শাহিদা পারভীনের জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবা-মায়ের নামের স্থলে উল্লেখ করা হয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ির নাম। সে হিসেবে তার বিয়ে হয়েছে আপন ভাইয়ের সঙ্গে! এ নিয়ে প্রায়ই চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় তাকে। এছাড়া সাবেক সেনাসদস্য স্বামীর পেনশন সংক্রান্ত জটিলতা তো রয়েছেই। কিন্তু বছরের পর বছর উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় নির্বাচন

কার্যালয়ে ঘুরেও জাতীয় পরিচয়পত্রের ওই ভুল সংশোধন করতে পারেননি তিনি। সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম ভুক্তভোগী শাহিদা পারভীনের আবেদনটি ‘গ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠিয়েছেন। এরপর কয়েকবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে গিয়েও ওই আবেদনের কোনো হদিস পাননি তিনি।

চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশ শাহিদা পারভীন ভোরের কাগজকে বলেন, উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের চাহিদা মোতাবেক বাবা-মা ও সব ভাই-বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি, ওয়ারিশ সনদ, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, আদালতের হলফনামাসহ আরো অনেক কাগজপত্র জমা দিয়ে বছরের পর বছর ঘুরেও কোনো কাজ হচ্ছে না। নির্বাচন অফিসের ভুলে আমার মতো হাজারো মানুষ নানা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এসব দেখার কি কেউ নেই?

ভুলের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অপেশাদার ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটর দিয়ে দ্রত কাজ করানো, অপেশাদার কোম্পানিকে এনআইডি তৈরির দায়িত্ব দেয়া এবং সর্বোপরি কোন চেকিং বা মনিটরিং ছাড়াই এনআইডি প্রস্তুত করার কারণে লাখো মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

অথচ প্রাথমিকভাবে এনআইডি ফরমে গ্রাহকরা নিজেদের তথ্য দিতে খুব বেশি ভুল করেননি বলে পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। রাজধানীর নির্বাচন ভবনের প্রশিক্ষণ শাখার এনআইডি উইংয়ে দিনের পর দিন ঘুরতে থাকা গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা বলেছেন, এনআইডির এসব ভুলের জন্য অপেশাদার কর্মচারী বা ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটররা দায়ী। তাদের অপেশাদার মনোভাবকেও দায়ী করেছেন গ্রাহকরা। অনেকে আবার ইসির কিছু অসাধু কর্মচারীকে ২-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে দু-তিন দিনের মধ্যে তার এনআইডির ভুল সংশোধন করতে সক্ষম হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, বিদেশে যেতে জরুরি ভিত্তিতে তার এনআইডিতে বাবার নামের ভুল সংশোধন করার প্রযোজন পড়ে। এজন্য ১৭ হাজার টাকা দিয়ে ৩ দিনের মধ্যে এনআইডি সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়াও শত শত গ্রাহক অর্থের বিনিয়ম ছাড়া এনআইডি সংশোধন হয় না বলে এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছেন।

এদিকে সময়মতো সংশোধন না হওয়ায় এনআইডির আবেদনের স্তূপ জমেছে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের (আইইটি ভবনের) প্রতিটি উপজেলা-জেলাভিত্তিক কর্মকর্তার টেবিলে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরেও গ্রাহকরা এসব ছোটখাটো ত্রুটি  সংশোধন করাতে পারছেন না। তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টেবিল পর্যন্ত যেতেই পারেন না। পিএস, পিএ, অফিস পিওন, চাপরাশিরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে গ্রাহকদের ঘেষতেই দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় তাদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় পাসপোর্ট-ভিসা হচ্ছে না। চাকরি হচ্ছে না, কেউ বেতন/পেনশন পাচ্ছেন না, কেউবা ব্যাংকের নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে টাকা তুলতে পারছেন না। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় অনেক হতদরিদ্র ভিজিএফসহ বিভিন্ন ত্রাণ নিতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত এ রকম অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জনভোগান্তির কথা স্বীকার করে জানান, ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্রের সংখ্যা কোটির কাছাকাছি। এসব দ্রুত সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিইসি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে অনেক হয়রানি আর ভোগান্তি হচ্ছে- আমি নিজেও জানি। কিছু কিছু মানুষের জন্য আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, প্রভুর মতো আচরণ করলে হবে না। জনগণের ভৃত্য হিসেবে কাজ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন অপরিসীম। ভুল বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে নজর রাখছি আমরা। এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক হুমায়ূন কবীর বলেন, প্রতিদিন বহু ফাইল সংশোধনের জন্য দেশের বিভিন্ন উপজেলা-জেলা অফিসে জমা পড়েছে। তা প্রধান কার্যালয়ে আসে। অধিকাংশের ত্রুটি বয়স বা নাম সংশোধনভিত্তিক।

তার স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দিতে পারায় তাদের এনআইডি সংশোধন করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মামলা থেকে বাঁচতে বা অন্য কোনো মতলবে অনেকে দ্বৈত ভোটার হচ্ছে বা নাম-বয়স পাল্টে নতুন এনআইডি করছে। এগুলো ঠেকাতে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। তবে যাচাই-বাছাই করে সব তথ্য সঠিক পাওয়া গেলে সেটি সংশোধনযোগ্য। অর্থ লেনদেনের কোনো ঘটনা জানা নেই দাবি করে হুমায়ূন কবীর বলেন, এমনটি প্রমাণ হলে ওই কর্মীকে শাস্তির আওতায় নেয়া হবে।

ইসির তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে প্রতিদিন হাজারখানেক আবেদন জমা পড়ে। সেই আবেদনগুলোকে ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। সামান্য ভুল থাকলে (‘এ’ ক্যাটাগরি ) তা উপজেলা-জেলা অফিস থেকে সমাধান করা হয়। কিন্তু নানা ছুতোয় উপজেলা বা জেলা কার্যালয় এনআইডি সংশোধনে নানান বাহানা দেখায়। এ কাগজ সে কাগজ চায়, যার ফলে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে লক্ষাধিক এনআইডি সংশোধনের জন্য পড়ে রয়েছে। আর বয়স বা জটিল কোনো সংশোধনের জন্য আবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে চলে আসে।

অর্থাৎ ‘বি’, ‘সি’ এবং ‘ডি’ ক্যাটাগরির আবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে পাঠান তারা। বর্তমান ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রায় ৩০ হাজার আবেদন এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির ১০ হাজারের ঊর্ধ্বে আবেদন ইসিতে জমা আছে। আর সবচেয়ে জটিল ‘ডি’ ক্যাটাগরির প্রায় ৫ শতাধিক আবেদন ইসিতে জমা পড়েছে। যেগুলো শুধু এনআইডি ডিজি সমাধান করতে পারবেন। এসব আবেদনের স্বপক্ষে তেমন কোনো কাগজপত্র বা প্রমাণপত্র জমা দিতে না পারায় আবেদনগুলোর সুরাহা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ইসি সূত্র।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App