×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাঁচ বিষয়ে গুরুত্বারোপ জরুরি!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২২, ১২:৩০ এএম

রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাঁচ বিষয়ে গুরুত্বারোপ জরুরি!

গতকাল বাংলাদেশে ‘রোহিঙ্গা প্রবেশের’ ৫ বছর পূর্তি হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন, নিষ্ঠুর অত্যাচার, পাইকারি হত্যাকাণ্ড, গণহারে ধর্ষণ এবং অবর্ণনীয় জেনোসাইড থেকে বাঁচার জন্য প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে (যদিও বাংলাদেশ তাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকার করে না!)। এ দিন বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও রোহিঙ্গা এক্টিভিস্টরা ‘জেনোসাইড স্মরণ দিবস’ হিসেবে পালন করে। বাংলাদেশেও উখিয়া এবং টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের কয়েকটিতে নানানভাবে ‘জেনোসাইড স্মারণ দিবস’ পালন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রায় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সমাবেশ করে এ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ ধরনের জমায়েত স্থানীয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিনা কিংবা এ ধরনের জমায়েতের মাধ্যমে নতুন আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে কিনা বা স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে কিনা এসব বিবেচনায় আর বড় কোনো জমায়েত করতে দেয়া হয়নি। তথাপি রোহিঙ্গারা প্রতি বছর ২৫ আগস্ট একটি ‘কাল দিন’ হিসেবে পালন করে। গতকাল রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের মিডিয়াও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের কথা মাথায় রেখে ‘রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্তি’ উপলক্ষে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিশেষ আলোচনা (টকশো) সভা আয়োজন করে। আমি যেহেতু রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘ বছর গবেষণার কাজ করছি, আমার কাছে মনে হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ৫টি বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেয়া একান্ত জরুরি। এমনিতেই রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন একটা জটিল আকার ধারণ করছে এবং এ জটিলতা ক্রমান্বয়ে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে নিম্নোক্ত ৫টি বিষয়ে গুরুত্বারোপ না করলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।

এক. বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা কত, তা নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এতদিন বলা হতো, ‘এ সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষাধিক’। সম্প্রতি সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অফিসিয়ালি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ।’ সেই সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রতি বছর নতুন করে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। জাতিসংঘের/ইউনিসেফের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর নতুন করে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। যে কোনো জনগোষ্ঠীর সংখ্যার বৃদ্ধির হিসাব করতে করতে হয়, ‘ফার্টিলিটি রেট’ থেকে ‘মর্টালিটিন রেট’ বাদ দিয়ে। সে হিসাবে, আমার জানামতে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে বছরে ৫ রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করে না। ফলে প্রতি বছর নতুন করে যুক্ত হওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে ৩০ হাজারের অধিক। তাহলে গত ৫ বছরে নতুন করে সর্বমোট রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখের অধিক। অনেকের কাছে এ তথ্য নাই যে, এখনো বাংলাদেশে নিয়মিতভাবে ‘স্লো মোশনে’ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ট্রানজিট ক্যাম্পে প্রতি সপ্তাহে ২৫০-৩০০ রোহিঙ্গা হাজির হয়। পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। একজন ক্যাম্প ইনচার্জ আমাকে আন-অফিসিয়ালি জানিয়েছেন যে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর প্রথম দুই মাসে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এরপরও গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে প্রায় ৩০-৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। তাহলে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে জন্ম নেয়া দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। আর, ‘স্লো-মোশনে’ প্রবেশ করতে থাকা ৩০-৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে একত্রে পরিসংখ্যান চার্টে বসালে, বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে ১৩ লক্ষাধিক। তাই বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, রোহিঙ্গা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা। যেহেতু প্রত্যাবাসনের আকাশে এখনো পর্যন্ত কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু এ হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে সেটা ২০ লাখে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দুই. দ্বিতীয় মনোযোগের বিষয় হচ্ছে, শিবিরের অভ্যন্তরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শিবিরে নানান দল-উপদলের মধ্যে দ্ব›দ্ব সংঘাতের কথা আমরা নিয়মিতভাবে মিডিয়াতে দেখছি। মাঝে মাঝেই অস্ত্রের ঝনঝনানি আমরা শুনতে পাই। কিন্তু ২০২১ সালে জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যার মধ্য দিয়ে শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জের ধরে অক্টোবরে মইন্যার ঘোনায় ‘সিক্স মার্ডার’-এর ঘটনাও বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ৫ বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১২৩ জন খুন হয়েছে। ৯১টি হত্যাকাণ্ডের ৮১টি খুনের মামলা হয়েছে। এছাড়াও ১৩২ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৮৪টি। ১৭৬টি অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয় ৪৮৭ জনকে। মাদকের মামলা আছে প্রায় হাজার খানেক। সবমিলিয়ে এটা সহজেই অনুমেয় যে, ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যা শিবিরের পরিবেশকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শিবিরের অভ্যন্তরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ অবনতি স্থানীয় জনগণের মধ্যেও একটা ভয় এবং আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

তিন. যদিও রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট সমস্যা ও সংকটের জন্য কোনোভাবেই রোহিঙ্গারা দায়ী নয়, বরঞ্চ তারা হচ্ছে ভুক্তভোগী, তথাপি প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশে যেসব সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগণ। একথা অনস্বীকার্য যে, পরিবেশের ব্যাপক ধ্বংসের পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিবেশ, অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং চাকরির বাজার প্রভৃতিতে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে একটা বিরাট নেতিবাচক ও ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে। ফলে স্থানীয় জনগণ তাদের নানান সমস্যা, সংকট এবং অসুবিধার জন্য প্রথম চিন্তাতেই রোহিঙ্গাদের দায়ী করে। ফলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে শুরু থেকেই। আর ৫ বছরে সেটা ক্রমান্বয়ে খারাপ হয়েছে। যদিও এখনো সম্পর্কটা একেবারেই মারমুখী হয়ে উঠেনি কিন্তু এ প্রবণতা চলতে থাকলে ‘হোস্ট-গেস্টের সম্পর্ক’ মারমুখী হয়ে উঠতে খুব বেশি দিন লাগবে না। তাই রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা ও ভরণ-পোষণের প্রতি নজর দেয়ার পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রশমনের দিকেও নজর দিতে হবে। ‘শরণার্থী সাপোর্ট মডিউলের’ নিয়মানুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা-ত্রাণের ২৫ শতাংশ হোস্ট কমিউনিটির জন্য ব্যয় করার কথা থাকলেও সেটা আদৌ হচ্ছে কিনা, সেটা তদারকি ও নজরদারি করা প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

চার. উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি এবং ভাসানচরে একটি, সবমিলিয়ে ৩৫টি শরণার্থী শিবির পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যের পরিমাণ সে তুলনায় ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। এক হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে চাহিদার বিপরীতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থের জোগান দিয়েছিল প্রায় ৭৩ শতাংশ কিন্তু ২০২২ সালে এসে চাহিদার তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জোগান দিয়েছে মাত্র ৪৯ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেশ বড় পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করতে হয়। সর্বশেষ হিসাব আমাদের কাছে না থাকলেও ‘প্রথম তিন বছরে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছিল প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা’ বলে দুই বছর আগে দাবি করেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সে হিসাবে যদি ধরে নিই, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা; তাহলে ৫ বছরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ১৫০ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার পরিমাণ যদি এভাবে ক্রমবর্ধমান হয়, তাহলে সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বড় মাপের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সুতরাং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব একা বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে পর্যাপ্ত অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

পাঁচ. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আর খুব একটা আগায়নি। এর মধ্যে করোনা মহামারি পুরো প্রক্রিয়াটাকে রীতিমতো বন্ধ করে দেয়। আবার ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের মিলিটারি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করায় পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, ২০২২ সালের জুনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের এক ভার্চুয়াল সভা হয় এবং সেখানে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল সীমিত আকারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কাজ হচ্ছে, মিয়ানমারের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। তাছাড়া মিডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা এখন মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি আছে যদি তাদের জীবনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া হয়। আমার মনে হয়, ‘মিয়ানামরের আগ্রহ’ এবং ‘রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে রাজি হওয়া’ দুটোকেই কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার দিকে গুরুত্বসহকারে মনোযোগ দেয়া জরুরি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App