×

জাতীয়

নাগালের বাইরে ওষুধের দামও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২২, ০৭:২১ এএম

** ১ মাস ব্যবধানেই ফের বাড়ানোর পাঁয়তারা ** মনিটরিং জোরদারের সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের **

রাজধানীর শাঁখারীবাজার এলাকার বাসিন্দা পরেশ রায় (৬৫) ও অঞ্জলি রায় (৫৪) দম্পতি। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। মাসে ওষুধ বাবদ এই দম্পতির খরচ হতো ১৩ হাজার টাকা। এছাড়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঞ্জলি রায়ের জন্য আরো কিছু ওষুধের প্রয়োজন হয়। সেগুলো বাবদ খবর আছে আরো দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এই দম্পতির ওষুধের জন্য মাসে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু জীবনরক্ষাকারী বেশকিছু ওষুধের দাম বাড়ায় এই খরচের খাতায় যোগ হয়েছে আরো প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এখন ওষুধ বাবদ মোট খরচ বেড়ে ১৮ হাজার টাকারও বেশি দাঁড়িয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পরেশ রায় বলেন, পুরো মাসের ওষুধ আমি একবারেই কিনতাম। কিন্তু যে হারে ওষুধের দাম বাড়ছে, এখন সপ্তাহের জন্য ওষুধ কিনি। দুশ্চিন্তায় আছি ওষুধ খাব না ভাত খাব?

শাহবাগে হ্যাপী ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে এসেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাজিমুদ্দিন (৫২)। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সকাল ও রাতে ৬ পদের ওষুধ খেতে হয়। দুপুরে খাই ৩ পদের ওষুধ। দুই বেলা প্রেসারের ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু যে হারে ওষুধের দাম বাড়ছে- মনে হয় ওষুধ কাটছাঁট করা ছাড়া উপায় নেই।

কোনো ধরনের ঘোষণা কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করেই জুলাই মাসে ওষুধের দাম বাড়ে। প্রাথমিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কাঁচামাল, এপিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য, মুদ্রানীতিসহ নানা কারণ দেখানো হয়। এক মাস যেতে না যেতেই আবারো অস্থিরতা দেখা দিয়েছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের বাজারে। চলছে ফের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা।

জানা যায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি জেনেরিক (শ্রেণিগত বা জাতীয়) ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর বাইরেও ১৬শ জেনেরিকের ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি হয়। সেগুলোর দাম নির্ধারণ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এখন ওই ওষুধগুলোর দাম বাড়ানোরই তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, সবশেষ ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। আর গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় অর্ধশতাধিক ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের করা প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে অধিদপ্তর মৌখিক সম্মতি দিলেও চিঠি বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই দাম বাড়ায় বিক্রেতারা। ৫৩ থেকে সংখ্যাটা হয়তো একশতে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিক্রেতারা।

গোপীবাগের মামুন ও নাহার ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ মামুন জানান, নাপা এইচসহ প্যারাসিটামল জাতীয় প্রায় সব ওষুধের দাম বেড়েছে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিক, প্রেশার ও পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১ পাতা প্যারাসিটামল (ট্যাবলেট) আগে ২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা মিলছে ৩৫ টাকায়। ৩০ টাকার প্যারাসিটামল সিরাপের বোতল এখন ৫০ টাকা, ৮ টাকার ১ পাতার নাপা (ট্যাবলেট) বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়, নাপা এক্সট্রেন্ড ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা, এনজিলক ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা, এমোডিস ১২ টাকা থেকে ১৭ টাকা, ডিজাইড (একবক্স) আগে ১০০ টাকায় মিললেও এখন তা ৫০০ টাকা। ওসাট্রিল ৮০ টাকার পাতা ১০০ টাকা, প্যানটোনিক্স ৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৯৮ টাকা, নাপা ও এইস সিরাপের বোতল ২০ টাকায় আগে বিক্রি হলেও এখন তা ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পাতা এন্টিবায়োটিক সেফ-৩ আগে কেনা যেত ১৩৫ টাকায়। এখন ১৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ওরস্যালাইনের মতো অতি জরুরি একটি ওষুধের দাম প্রতি প্যাকেটে ১ থেকে ২ টাকা বেড়েছে।

ওষুধের দাম বাড়া প্রসঙ্গে শাহবাগের মা ফার্মেসির বিক্রেতা মো. রিয়াজুল বলেন, কিছুদিন আগেই ওষুধের দাম বেড়েছে। এখন আবার কিছু ওষুধের দাম বাড়তির দিকে। শুনছি আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে দাম আরো বাড়বে। দাম আরো বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, বাড়তি দামে বিক্রির জন্য বাজারে ওষুধ না ছেড়ে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ওষুধ মজুত করছে। মিটফোর্ডে কোটি কোটি টাকার ওষুধ মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির একটা পাঁয়তারা চলছে। দাম বাড়লে সেগুলো বাজারে ছাড়া হবে।

এ প্রসঙ্গে ওষুধ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ওষুধের দাম আমরা ইচ্ছা করলেই বাড়াতে পারি না। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। অনুমোদন ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ানো সম্ভবও নয়। আবেদন সাপেক্ষে অধিদপ্তর তা যাচাই-বাছাই করে। এক্ষেত্রে তারাও আইন-কানুন ও নীতিমালা অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত দেয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন জানান, কাঁচামালের দাম বেড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কোম্পানিগুলো লোকসান দিয়ে তো ব্যবসা করবে না। তবে ঔষধ প্রশাসন এককভাবে কারো দাম বাড়িয়ে দেয় না। যখন যে কোম্পানি দাম বাড়াতে আসবে; তারা যদি ব্যয়ের কারণ দেখাতে পারে- তখন সেটি আমাদের ফর্মুলার মধ্যে যদি থাকে তাহলে দামটা বাড়াতে পারে। তবে অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কেউ দাম বাড়াতে পারে না। কেউ যদি বাড়িয়ে থাকে তাহলে সেটা অন্যায়।

তবে ভোক্তা পর্যায়ে এভাবে ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়টিকে আজগুবি বলে আখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা করা ছাড়াও ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে সরকার। আমাদের দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও তা ছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হলো, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে, বাকিটা করবে কোম্পানি। একে বলা হলো ইন্ডিকেটিভ প্রাইস। এ রকম আজগুবি নিয়ম দুনিয়ার কোথাও নেই।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মনে করেন, তদারকি না থাকায় কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, গত জুলাইয়ে এসেনশিয়াল ড্রাগের দাম বাড়ানো হয়েছিল। যেগুলো সরকারের ফর্মুলা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। এখন আবার শুনছি সরকারের ফর্মুলার বাইরে যেসব ওষুধ রয়েছে সেগুলোরও দাম বাড়ানো হবে। যে কোনো সময় সরকার বা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নতুন সেই দাম ঘোষণা করবে। এখন যদি দ্বিতীয় দফায় ওষুধের দাম বাড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষ রোগে ভুগে মারা যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App