×

মুক্তচিন্তা

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২২, ১২:২৯ এএম

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

জ্বালানি তেলের দাম কিছুদিন আগে এমন হারে বাড়ানো হয়েছে যা অতীতে প্রত্যক্ষ করা যায়নি। গড়পড়তা বৃদ্ধির হার ৪২-৫২ শতাংশ। শোনা যায় অচিরেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। রেলের ভাড়া বৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দিচ্ছেন রেলমন্ত্রী। ইতোপূর্বে ভোজ্যতেলের দামও দ্বিগুণ করা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বাড়বে এমন আশঙ্কা ছিল, কিন্তু এতটা বাড়বে কেউ ধারণা করতে পারেননি। জীবনযাত্রা প্রতিপদে বিপর্যস্ত হচ্ছে। নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা দুরূহ হবে। প্রাপ্ত তথ্যমতে জ্বালানি তেল আমদানির ওপর প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আরোপিত আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও যদি কিছুটা ছাড় দিত তাহলেও বৃদ্ধির হার সহনশীল হতো। তেমন ব্যবস্থা না নেয়ায় অভিঘাতের সবটুকুই পড়ল ভোক্তা সাধারণের ওপর। তছনছ হয়ে গেল মানুষের প্রাত্যহিক জীবন। বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হলো কৃষি খাতে। অল্প কিছুদিন আগে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি ৬ টাকা। এখন ডিজেলের দাম বাড়ল লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা। সার ও ডিজেল চাষাবাদের অপরিহার্য উপকরণ। উপকরণ দুটির দাম অত্যধিক বাড়ায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চলমান বছরটি কৃষক ও কৃষির জন্য ভালো নয়। ধানের প্রধান আবাদ বোরো-ইরির স্বর্ণভাণ্ডার দেশের হাওর অঞ্চল। পাহাড়ি ঢলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবার হাওরের ফসল। হাওরের কৃষকদের বাঁচাতে সারাদেশের মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হলো। একটিমাত্র ফসলই অবলম্বন হওয়ায় হাওরবাসীকে সারা বছর কষ্ট করতে হবে। সমতল ভূমির ইরি ধানও কৃষক ঠিকমতো গোলায় তুলতে পারেননি উপর্যুপরি বৃষ্টির কারণে। আবার আমন চাষের ভর মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে খরা। ডিজেলচালিত পাম্প দিয়ে আমনের চারা রোপণ করতে হচ্ছে। সারের পর ডিজেলের এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি চাষাবাদে নিশ্চিত বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এতে হুমকির সম্মুখীন হতে পারে খাদ্য নিরাপত্তা। বর্তমান সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে, কিন্তু‘ বিদ্যুৎ দিতে পারছে না জ্বালানির অভাবে। দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন। বলা হয়েছিল দৈনিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে পরিকল্পিত উপায়ে। পরিকল্পনায় চিড় ধরেছে, দফায় দফায় বিদ্যুৎহারা হচ্ছে মানুষ। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বড় অভিঘাত পড়ে গণপরিবহনে। বাস মালিকরা সুযোগ নিতে কিয়ৎকালও বিলম্ব করেন না। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এক অর্থে তাদের জন্য শাপে বর। খরচ যতটা বাড়ে তার চাইতে অধিক হারে আদায় করা হয় ভাড়া। যাত্রীরা অসহায়, তাদের প্রতিবাদ ধোপে টেকে না। ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের উদ্ধত আচরণের মুখে তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। এমন বিশৃঙ্খলা চলছে যুগের পর যুগ। নিয়ন্ত্রণের কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেই। বাসের ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে বিআরটিএর যদিওবা কিছুটা কর্তৃত্ব আছে, ট্রাক-লরির ভাড়া নির্ধারণের ব্যাপারে কারো কোনো কর্তৃত্ব নেই। ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে পরিবহন খরচ বাড়ানো হয়, যার সমুদয় দায় চাপে ভোক্তা সাধারণের ওপর। মনিটরিংয়ের অভাবে এদেশে পদে পদে জিম্মি ভোক্তারা। কেরোসিনের ভোক্তা মূলত হতদরিদ্র মানুষ। এর মূল্যবৃদ্ধি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সাম্প্রতিক এই মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই নিজ নিজ মতামত দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ পেট্রল ও অকটেনের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে নমনীয়। তারা মনে করেন, বিত্তবানরা পেট্রল-অকটেনের ক্রেতা, এই ক্রেতাগোষ্ঠী অভিঘাত সইবার ক্ষমতা রাখেন। বাস্তব পরিস্থিতি যে অনেকটাই ভিন্ন এটি তাদের নজরে পড়ে না। উদাহরণ হিসেবে মোটরসাইকেলের কথা ধরি। দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা অসংখ্য। সাধারণ মানুষ এর ব্যবহারকারী। তাদের একাংশ আবার রাইডশেয়ারিংযের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পেট্রল-অকটেনের মূল্য বাড়লে তাদের জীবিকায় টান পড়ে। সংকটের শেকড় প্রোথিত ভুল জ্বালানি নীতিতে। স্বনির্ভরতার পরিবর্তে আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বা পুরনো কূপ আধুনিকায়ন করে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া হয়নি দীর্ঘদিন। নতুন সমুদ্রসীমাতেও গ্যাস অনুসন্ধানের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। পরিবর্তে জোর দেয়া হয়েছে আমদানির ওপর। আমদানি করা তেল ও এলএনজির ওপর নির্ভর করে গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুতের বিভিন্ন প্ল্যান্ট। এখন সেসব প্ল্যান্ট চালানো সম্ভবপর হচ্ছে না। দফায় দফায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জনজীবনতো বিপর্যস্ত হচ্ছেই, বিপন্ন হচ্ছে বিনিয়োগ পরিস্থিতি। তাতে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন বিপদসংকুল পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে সরকারকেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ২০১৬ সালের উদাহরণ টেনে ভবিষ্যতে মূল্য সমন্বয়ের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। যথাশিগগিরই সম্ভব জ্বালানির মূল্য কমিয়ে এ প্রতিশ্রæতি রক্ষা করা হোক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি আখেরে দেশের উন্নয়ন সহায়ক হবে। গণমাধ্যমের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ টন। প্রতি বছর এ চাহিদা বাড়ছে। জ্বালানি তেলের একমাত্র পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, যেটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধন ক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন। এর সক্ষমতা বাড়ানো গেলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হতো। ২০১২ সালে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, যা সম্পন্ন হলে পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াত ৬৫ লাখ টন। [সূত্র : প্রথম আলো, ৮ আগস্ট ২০২২] দুঃখজনক যে এক দশকেও প্রকল্পটি শুরু হতে পারেনি, দপ্তরে দপ্তরে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রফাইল। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো প্রকল্পের যদি এ রকম দশা হয় তো দুর্গতি হ্রাস পাবে কী করে। অনুরোধ করব, পরিস্থিতি নতুন করে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে, যাতে ভবিষ্যতে দুর্দশায় পড়তে না হয়। এ মুহূর্তে ঢাকায় সাবওয়ে করার মতো বিলাসী প্রকল্পের প্রয়োজন দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। প্রয়োজন ঢাকার ওপর চাপ কমানোর প্রকল্প। নয়তো ঢাকা বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হবে। ঢাকাকেন্দ্রিক সব প্রকল্প মাঠে মারা যাবে। হাইওয়ে বাদে গ্রামগঞ্জের অনেক রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে একাকার, মফস্বলের অনেক শহরের অবস্থাও করুণ। উন্নয়নে পরিকল্পনার ছাপ নেই অনেক ক্ষেত্রে। কেবল বড় বিষয় নয়, ছোটখাটো বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে। সরকার একলা চলো নীতির ওপর অনেক বেশি আস্থাশীল মনে হচ্ছে। এটি ঠিক নয়। বিশেষায়িত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিদের কথা শুনলে দেশের মঙ্গলই হবে।

মজিবর রহমান : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App