×

মুক্তচিন্তা

ইতিহাস বিকৃতি কী ও কেন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২২, ১২:২৮ এএম

ইতিহাস বিকৃতি কী ও কেন?

জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট ১৭ আগস্ট সাংবাদিকদের উদ্দেশে যে বিবৃতি দিয়েছেন তা প্রথম আলো (২১ আগস্ট, ২০২২) পত্রিকায় ‘মানবাধিকার ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাব রয়েছে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। আমি সাংবাদিক নই, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল এবং কোনো রাজনীতিক নই, তাই মানবাধিকার প্রশ্নে আমার কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। আমার পর্যবেক্ষণ অন্যত্র, যার একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে, অপরটি হচ্ছে শেখ হাসিনাকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ‘বাংলাদেশে আমার আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শোক দিবসের সঙ্গে মিলে গেছে, সে সময় দেশটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ঘটনা স্মরণ করেছে।’ আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতাকে সর্বজনগ্রাহ্য ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় উল্লেখ করেছেন। তাতে তার কণ্ঠে জনপ্রত্যাশার প্রতিধ্বনি হয়েছে। দিনটি সম্পর্কে তার ব্যবহৃত বিশেষণগুলো অবশ্য দৃকপাত ও বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে। আমি সেখানেও যাব না। আমার জিজ্ঞাসা বঙ্গবন্ধু কী করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন? তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে বাংলাদেশ কি স্বাধীন হয়েছে? মিশেল ব্যাশেলেট এর এই জাতীয় ভুল কি ইচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাবশত না অসাবধানতাবশত? এর একটিও কিন্তু এই মাপের একজন ব্যক্তিত্বের কাছে বাঞ্ছনীয় নয়। তার এ কথায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতিতে একটা নতুন ডামেশন যুক্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ মন্তব্য বা প্রতিবাদ করেছিল কিনা আমি জানি না। তবে আমার মন্তব্য হচ্ছে যে, তিনি অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। তার বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অবগতি বাঞ্ছনীয় ছিল। তিনি সর্বাংশে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধটাকে অবজ্ঞা করেছেন, যা যে কোনো সমাজ সচেতন ও সামান্য ইতিহাস সচেতন মানুষ মাত্রই জানার কথা ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আর তার পকিস্তান থেকে মুক্তি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। এ সরকার কোনো অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকার ছিল না। কিন্তু তার অপ্রতিরোধ্য অনুপস্থিতির কারণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার দায়িত্ব পালন করেন। সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জননেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং সে পদে তিনি ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন? এই মহান নেতার শাহাদাত দিবসে অন্যান্য দেশের বিশিষ্ট সফরকারীদের ন্যায় তিনিও বঙ্গবন্ধু ভবনে সম্মান জানাতে যেতে পারতেন। সেটাও তার অভিরুচি, সংস্কার পক্ষপাতিত্ব ও অভিরুচির কারণে ঘটল না কিনা বুঝতে পারলাম না। আমি আগেই বলেছি আমার অযোগ্যতার কারণে আমি মানবাধিকার নিয়ে কোনো কথা বলব না। তবে ১৫ আগস্ট ইতিহাসের এই কলংকিত ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল এবং কারো কারো মতে গণহত্যার শামিল; কেননা ওই দিনে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, নিরপরাধ নারী, শিশু ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছে। এই অপরাধটি মানবাধিকারের চরম অবমাননা বলে চিহ্নিত করলে কী অন্যায় হবে? একজন জাতিসংঘ মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের মানবাধিকার নিয়ে বক্তব্য থাকবেই; কিন্তু তার সূচনা ঘটা প্রয়োজন ছিল প্রায় সপরিবারের বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকে নিয়ে। আমি ‘প্রায়’ শব্দটি ব্যবহার করেছি কেননা সেদিনের এই গণহত্যার লগ্নে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে থাকলে তারাও নিষ্কৃতি পেতেন না। তাদের আচরণ ছিল দানবের মতো। তারা ৬ বছরের শিশু সুকান্ত বাবু ও ১০ বছরের রাসেলকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে দ্বিধান্বিত ছিল না। এই হত্যার বিচার বা মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যাপক গণহত্যার বিচার কর্ম সম্পাদনও কিছু দেশি-বিদেশি সুশীল ও স্বজ্ঞানীরা সহজেই মেনে নিতে পারেননি। আমাদের সৌভাগ্য কেননা শেখ হাসিনা স্রষ্টার কৃপায় বেঁচে ছিলেন বলেই আজকের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য শহীদ প্রাতঃস্মরণীয়। তা না হলে মিশেল ব্যাশেলেটের আর্কাইভ খুঁজে শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু নামে কাউকে স্পৃহা জাগত না। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনা নামেই পরিচিত ও স্বীকৃত। তাহলে তার নাম মিশেল ব্যাশেলেট কীভাবে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলে আবিষ্কার করলেন, তাও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। মানুষ তার নিজকে বা নিজের নামটাই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আমার অতি নম্র, বিনয়ী ও অদ্বিতীয় ভদ্র, এক শিক্ষককে জীবনে কোনোদিন কারো সঙ্গে কোনো উচ্চ-বাচ্য বা খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি, কিন্তু তার নামটি কেউ বিকৃতভাবে লিখলে বা উচ্চারণ করলে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন। মানুষের এই মৌলিক প্রবণতা অস্বীকার করা বা অসঙ্গতভাবে উল্লেখটা কি মিশেল ব্যাশেলেট নামের একজন বড় মাপের ব্যক্তির কাছে কাম্য? মিশেলের বিবৃতির প্রকাশনার দিনে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে কি অপরিমেয় ও অসামান্য মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল, তা কি আমাদের স্মরণে আছে?

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App