×

জাতীয়

সিন্ডিকেট ভাঙার পদক্ষেপ নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২২, ০৮:০৮ এএম

সিন্ডিকেট ভাঙার পদক্ষেপ নেই

প্রতীকী ছবি

ভোগ্যপণ্যের বাজারে কারসাজি ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ ও কঠোর আইনের তাগিদ

স্বস্তির খবর নেই বাজারের কোনো পণ্যেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপণ্যের বাজারও টালমাটাল। সপ্তাহের ব্যবধানে সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চাল-তেল থেকে মাছ-সবজিসহ প্রায় সব নিত্যপণ্য নিয়েই চলছে মুনাফার কারসাজি। সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। হালে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় ডিমের দাম। এরপর সরকারের তদারকিতে হঠাৎ করেই আবার কমেও যায়। সরকারের কর্মকর্তারাই বলছেন, শুধু ডিমে কারসাজি করেই ২-৩ দিনে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট। তবে এখনো সিন্ডিকেটে জড়িতদের চিহ্নিত করা বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।

নিত্যপণ্যের বাজার কার নিয়ন্ত্রণে? এমন প্রশ্ন প্রায় সব ক্রেতার। কারণ পণ্যের বাজার সকালে এক রকম, বিকালে আরেক রকম। যেসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়, সেসব পণ্যেরও দাম বাড়ছে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই। দামের চাপে ক্রেতাসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজারে গিয়ে পছন্দের পণ্য চাহিদামতো কিনতে পারছেন না অনেকেই। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে গিয়ে জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না কিনেই ঘরে ফিরছেন তারা। এক্ষেত্রে সরকার যেন একেবারেই অসহায়। সবকিছুর চাবিকাঠি বাজার সিন্ডিকেটের হাতেই। কোনোভাবেই এই অসাধু চক্রকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আরো কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। এ সংক্রান্ত আইনও আরো কঠোর করতে হবে। সরকারকে আরো কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানও বলেছেন, সিন্ডিকেট আজকাল সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। যে কোনো সেক্টরে পণ্যের দাম বাড়লে বা কমলে সিন্ডিকেটকেই দায়ী করা হয়। সম্প্রতি জাতীয় রপ্তানি ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যারা সিন্ডিকেট করে, যারা জনভোগান্তি বাড়ায় তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি কিছু অসাধু ব্যক্তির জন্য যাতে গোটা ব্যবসায়ী সমাজের সুনাম ক্ষুণ্ন না হয়, সে ব্যাপারে জনগণকেও সজাগ থাকতে হবে এবং সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুক্তবাজার অর্থনীতির মধ্যেও পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার মাঝেমধ্যে চাল ও তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম ঠিক করে দেয়। এতে বাজারে উল্টো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে এবং দাম আরো বেড়ে যায়। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, সব ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেট আছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্থা বাজারে তদারকি করে, কিছু টাকা জরিমানা করে- এটা তো কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। সিন্ডিকেট যে আছে, এর একটা তথ্য থাকতে হবে। সিন্ডিকেট সাধারণ একটি শব্দ। এ সিন্ডিকেটের পেছনে কারা যুক্ত আছে, ওরা কীভাবে কারসাজি করছে- এসব বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হয় না। বাজারে গিয়ে ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়। অথচ এর পেছনের রাঘববোয়ালদের নাম প্রকাশ হয় না। তিনি বলেন, বাজারে কারা একচেটিয়া ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে- এ বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব প্রতিযোগিতা কমিশনের। অথচ সুপরিকল্পিত তদন্তের ভিত্তিতে কঠিন কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আমরা কখনোই দেখিনি। এজন্যই বারবার সিন্ডিকেট করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এসব সিন্ডিকেটবাজ সব সময় পেছনেই থাকতে পছন্দ করে। অথচ রিমোট কন্ট্রোল তাদের হাতে থাকে। কিন্তু এই রিমোট কন্ট্রোল খুঁজে বের করা, এটা চিহ্নিত করা প্রতিযোগিতা কমিশনের কাজ। আর আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। অথচ এসব কিছুই দেখি না।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার যখন অভিযান চালায়, তখন অবৈধভাবে মজুত থাকলে বা সিন্ডিকেট করলে তাদের জরিমানা করে। ব্যবসায়ীরা পরে আবার ভোক্তার উপরেই চাপ সৃষ্টি করে। এর চেয়ে কীভাবে শাস্তি আরো বাড়ানো যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, এসব সিন্ডিকেটের হাতে সরকারও কিছুটা জিম্মি হয়ে আছে। আমি মনে করি, এজন্য শাস্তির ধরন পাল্টাতে হবে।

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও বাজার কেন অস্থিতিশীল, কারা কারাসাজির মাধ্যমে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে অবৈধ উপায়ে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের ধরতে মাঠে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিযোগিতা কমিশন।

মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশনের আইনে সরাসরি জেল দেয়ার বিধান নেই। শুধু আর্থিক জরিমানা করা যায়। তবে আমাদের আদেশ না মানলে ফৌজদারি মামলার সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি মামলায় জেলের বিধান আছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের মূল কাজ হচ্ছে বাজারকে প্রতিযোগী করা। সেলক্ষ্য অর্জনে আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন, স্থায়ীভাবে সিন্ডিকেট বন্ধ করা সম্ভব নয়। সাধারণ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সাপ্লাই এবং ডিমান্ডের ওপরে বাজার পরিচালিত হয়। কে কখন কীভাবে বাজার সিন্ডিকেট করবে এটা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। তবে আমরা মার্কেট স্টাডি করতে পারি। মার্কেট কেমন আছে, সে স্টাডি আমরা আগেই করেছি। ডিম ও মুরগির বিষয়ে ৪০ কোম্পানির ওপরে স্টাডি করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে যা হয়েছে তা অনৈতিক। রবিবার এ বিষয়ে মতবিনিময় সভা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ আমরা বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। এরপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। তিনি আরো বলেন, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। এরপরও আমরা নিজেরা বাজার তদারকি করে ইতোমধ্যে ৮ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছি। ডিমের বিষয়ও আমরা নিজেরা তদারকি করেছি। ইভ্যালি নিয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। আমরাই বিষয়টি তদারকি করে মামলা করেছি। সিন্ডিকেট নির্মূল করা বিষয়ে তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের স্থায়ী সমাধান করা মুশকিল। বড় কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। তবে অবশ্যই এর কবল থেকে উত্তরণের উপায় আছে। আমরা সে চেষ্টাই করছে।

দেখা যাচ্ছে, নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম দিন দিন জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। একেক সময়ে একেকটি ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর ফলে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকার অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে পারছে না। সময়ে সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী, সচিব ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বশীলরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন- কীভাবে দ্রব্যমূল্য কমানো যায় তার পন্থা খুঁজতে। আর এ বৈঠকে ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেয়া বাড়তি দামই অনুমোদন দেয়া হয় খোদ সরকারি তরফে। এতে ব্যবসায়ীদের অন্যায্য দাবিরই বাস্তবায়ন ঘটছে।

প্রতি বছর বাজেটের আগে ব্যবসায়ীরা কর-সুবিধা নেয়ার জন্য তদবির শুরু করেন। এখানেও কে কতটা সুবিধা পাবেন তা নির্ভর করে কার সিন্ডিকেট কতটা শক্তিশালী তার উপরে। এক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের আশি ভাগের বেশি উৎস তৈরি পোশাক খাতই সবচেয়ে বেশি প্রণোদনা ভোগ করে। জনগণের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে ব্যাংক থেকে। সেই টাকা উদ্ধার করতে পারছে না সরকার। এ ঋণখেলাপিদের সিন্ডিকেটটি এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক উল্টো অর্থ ফেরত দিতে নানা ছাড় দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। তাও টাকা উদ্ধার করা যাচ্ছে না তাদের কাছ থেকে।

সিন্ডিকেট কী? : একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে কোনো একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল করা, ইংরেজি ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির মানে অনেকটা এমনই। অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেটের আলাদা একটি গুরুত্ব আছে। একটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে যখন কোনো উদ্যোগ, বিনিয়োগ বা লেনদেন সম্ভব হয় না; তখন অনেকে মিলে সেটি করলে তাকে সিন্ডিকেট হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক আর আতঙ্কের এক শব্দে পরিণত হয়েছে, যা দিয়ে তারা ব্যবসায়ীদের এক ধরনের মেকানিজমকে বোঝেন, যার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে ভোক্তাদের ঠকানোর যাবতীয় আয়োজন করা হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে- ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সরকার কেন এতটা নতজানু? রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের টাকা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় চলে, সেটি নতুন নয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন শুধু আড়ালে থাকছেন না, সরাসরি রাজনীতির মাঠেই নেমে পড়েছেন। তারাই আইন প্রণয়ন করছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি ঠিক করছেন এবং সরকার চালাচ্ছেন। আর এজন্যই বাজারে এত বেশি সিন্ডিকেট হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App