×

মুক্তচিন্তা

চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মানতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২২, ০২:০৬ এএম

চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মানতে হবে
রাজনৈতিক আড্ডা থেকে শুরু করে প্রিয়জনের সঙ্গে অবসর সময় কাটানো চা ছাড়া জমেই ওঠে না। শহর ও গ্রামে সর্বত্র চা পাওয়া যায়। কারণ চা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পানীয়রূপে পরিণত হয়েছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যারা এই চা উৎপাদন করে সারাদেশের মানুষের তৃপ্তি জোগায়, সতেজ করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি সতেজ আছে? তারা যে বেতন পান তাতে কি তাদের সংসারের খরচ থেকে শুরু করে চিকিৎসা, বস্ত্র এবং সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব? নিঃসন্দেহে উত্তর না। না বলেই চা শ্রমিকদের চা-বাগান থেকে বের হয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামতে দেখা যায়, যাচ্ছে। এই আন্দোলন বেঁচে থাকার আন্দোলন, খেয়ে-পরে বাঁচার আন্দোলন, নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন। কোনো বিবেকবান মানুষ এমন আন্দোলনে সঙ্গতি না জানিয়ে চুপ থাকতে পারে না, পারেনি কখনো। ভারতবর্ষে চায়ের চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধনকৃত মোট চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। নিবন্ধন ছাড়াও আরো অনেক চা-বাগান বিদ্যমান। গত ৯ আগস্ট দেশের ২৪১টি চা-বাগানের দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কর্মবিরতির মধ্য দিয়ে আন্দোলনে নামে। আন্দোলন তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য। দৈনিক সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। সপ্তাহে তিন কেজি আটা পায় দুই টাকা কেজি দরে। পরিবারে যদি ছয়জন সদস্য থাকে তবে তিন কেজি আটা কতদিন খেতে পারবে? আর ১২০ টাকা দিয়ে কী পরিমাণ চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারবে? চিকিৎসা আর শিক্ষা ফ্রি পাওয়ার কথা। তবে সেগুলো কি তাদের কপালে জোটে? না জুটলে চা শ্রমিকরা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাবেন কেমন করে? এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে বুঝে চা-বাগানের শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে নামে। তাদের দাবি পরিষ্কার। দৈনিক বেতন ৩০০ টাকা করে দিতে হবে। দুই বছর অন্তর চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির নীতি আছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর আর মজুরি বাড়ানো হয়নি। দিনে দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে সমস্ত জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পরিমাণে তারা মজুরি পেয়ে আসছেন তাতে তাদের বেঁচে থাকাই মুশকিল। সন্তানদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ থাকলেও পরবর্তী শ্রেণিতে আর পড়াতে পারেন না। কারণ এক সন্তানকে পড়াতে গেলে এনজিওর কাছে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু বাকি সন্তানগুলো আর পড়ার সুযোগ পায় না। দৈনিক যে মজুরি তাতে ঋণ পরিশোধ করবেন কেমন করে। ফলে তাদের সন্তানরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সবার চোখের দৃষ্টির সামনে দিয়েই। শিক্ষা যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দায়ভার কি রাষ্ট্র এড়াতে পারে? চা শ্রমিকদের সন্তানের জীবনের দিকে তাকালেই বিবেকবোধযুক্ত মানুষ স্বচ্ছ কাচের মতো তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাবেন। আর তা হলো বাবা-মায়ের মতো চা বাগানের শ্রমিক হওয়া। চা বাগানের শ্রমিক দয়াল আমলিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা মাছ মাংস বছরে এক-দুইবার খেতে পারি কোনো উৎসবের সময়। আর সারা বছর ঘরের পাশে লাগানো শাকসবজি দিয়ে চালিয়ে নিই। আর সব বেলায় খেতে পাই না।’ এক পর্যায়ে তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন আমরা না খেয়ে থাকি। আমাদের সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারি না। এনজিওর যে স্কুল এখানে আছে তাতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়ানো হয় না।’ দিনে দিনে চা শ্রমিকের পরিবার পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পুষ্টিহীনতার কারণে সন্তানদের শারীরিক থেকে মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের অগ্রগতি থেকে প্রগতি কিছুই নেই। যা আছে তা খুবই নগণ্য। এভাবে কত দিন চলবে? অনেক দিন ধরেই তো চলে আসছে। গতানুগতিকভাবে কি তারা শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হতেই থাকবেন? দূরদূরান্ত থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে বুনো টিলায় চা বাগানগুলো গড়ে উঠলেও শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি মেলেনি তাদের। দেশ স্বাধীনের ৫১ বছরে এসেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের ঘরবাড়ি খুবই নিম্নমানের। কারোরই ভূমির অধিকার নেই। তাদের খাটানো হয় অত্যধিক; কিন্তু মজুরি দেয়া হয় খুবই সামান্য। অশিক্ষা, অপুষ্টি, দারিদ্র্য এসবের সঙ্গে তাদের নিত্য বসবাস। চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের সব ন্যায্য দাবি মালিক ও সরকার উভয়কে সম্মিলিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে মেনে নিতে হবে। শুধু মেনে নিলেই হবে না তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। চাসহ দেশের সব শ্রমিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, কর্মস্থলে নিরাপত্তাসহ বেতন বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার বাস্তব রূপ দিতে হবে। জাফর হোসেন জাকির লেখক, ঢাকা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App