×

মুক্তচিন্তা

বক্তব্য ও শব্দচয়নে অসতর্কতা ঝুঁকি বাড়ায়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২, ১২:৫০ এএম

বক্তব্য ও শব্দচয়নে অসতর্কতা ঝুঁকি বাড়ায়

অহেতুক খুশি করতে গিয়ে বিপাকে ফেলে দেয়া হয় খুশি করতে চাওয়া মানুষটাকে। এতে তার সঙ্গে তার পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে সংকটের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। কারণ এমন অহেতুক খুশি করার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ, কল্যাণকর কিছুই থাকে না। যা থাকে তা হলো তেলবাজি, চাটুকদারি বা তোষামোদি এবং যা রাজনীতিতেই প্রকট আকার নিয়ে থাকে। কিংবা অতিরিক্ত আবেগের কারণে ব্যক্তির আবেগীয় বৈকল্য বা ইমোশনাল ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে। এটা সব রাজনৈতিক দলের ভেতর থাকে। বিশেষ করে নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে কমবেশি দেখা যায়। যদিও প্রশ্ন থেকে যায় নেতাদের সবাই এতে খুশি হন কিনা। যাই হোক, রাজনৈতিক দলের ভেতর তোষামোদি, চাটুকদারি আচরণ যেমন খুব বেশি থাকে, ঠিক তেমনি নেতার জন্য এই অতিরিক্ত কিছু করতে তার অনুসারীদের অতি আবেগ লাগে। আর এই অতি তোষামোদ বা আবেগপ্রবণতা ব্যক্তির সুস্থ মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে বা ভেঙে দেয়। যেটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আবেগীয় বৈকল্য বলা হয়। এতে ব্যক্তি অসংলগ্ন, অর্থহীন কথা বলেন। একটা পর্যায়ে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক আচরণ করতে ব্যর্থ হন। মানসিক সুস্থতা হারান। ক্রমান্বয়ে তিনি সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যান। তাকে ঘিরে তিরস্কার, কট্টর সমালোচনা হলেও তিনি কিন্তু তা বুঝতে পারেন না। মূলত বোঝার ক্ষমতা থাকে না। অনেকটা নির্বোধ হয়ে পড়েন। বুদ্ধির জড়তা পেয়ে বসতে পারে। উপরন্তু তিনি মনে করেন, তিনি যা বলছেন বা করছেন সেটাই সঠিক ও উত্তম তার লক্ষ্য ব্যক্তির জন্য। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইন্ডিয়ার প্রতি তার অনুরোধ প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা উপরে উল্লিখিত কোনো একটি কারণে হতে পারে কিনা ভেবে দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করছেন সরকারপ্রধান তথা নেতাকে খুশি করতেই তিনি এমন বেকুব অথচ দুঃসাহসিক বক্তব্য দিয়ে ফেলেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ উৎসবে। যাতে কিনা তিনি তার নেতাকেই সমালোচিত করার পথটি উন্মোচন ও সুগম করেছেন। বিশেষ করে বিরোধী দলকে সেই সুযোগ দেয়া হয়েছে। অনেকের মতে, এক ঢিলে দুই কাজ করতে চেয়েছেন তিনি সম্ভবত। এক. হিন্দু সম্প্রদায়কে খুশি ও আশ্বস্ত করে রাখা। দুই. নেতার জন্য তার অতিভক্তি প্রমাণে আবেগীয় উচ্ছ¡াস প্রকাশ করা। নেতাকে রক্ষার জন্য তিনি বিশেষ কাজ করছেন সেটা বলা। কী হলো তাতে? বর্তমান সরকার ও তার প্রধানের অস্তিত্বকে অবমূল্যায়ন করা হলো। যোগ্যতা ও সক্ষমতাকে হেয় করা হলো, প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। বিশেষ করে সরকার প্রধানকে বিতর্কের মালা পরিয়ে দিলেন স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অতি আবেগপ্রবণ ইদানীং তিনি। এতে তার বিচক্ষণতা লোপ পাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে তার কথা নিয়ে বেশ তোলপাড় চারদিকে। ইতোপূর্বে তিনি বৈশ্বিক সংকটে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনগণ ভালো আছেন বলতে গিয়ে তিনি বলে ফেলেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে। তুমুল সমালোচনার ঝড় ওঠে তাতে। কারণ যেই সময়টায় তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন যখন বাংলাদেশে জ¦ালানির মূল্য ৫২ শতাংশ বাড়ানোর ফলে নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতি হয়ে পড়েছে এবং যা সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার একেবারেই বাইরে চলে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কিছুতেই ভাঙতে পারছে না সরকার। এমন একটি সময়ে বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন এমন মন্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিলে জনসাধারণের মনে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়। তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাকে রাজনৈতিকভাবে লুফে নিয়েছে বিএনপি। যদিও বিএনপির সরকার আমলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শিশুর মৃত্যু হলে বলেছিলেন, আল্লাহর মাল আল্লাহ তুলে নিয়েছেন। বিএনপির আরো একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের কথা বলেছিলেন, যা জনগণের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজনীতিকদের বেফাঁস কথা বলার প্রবণতা নতুন নয়। বক্তব্য ও শব্দচয়নে এরা মোটেও সতর্ক নন। একটা কথা না বললেই নয় যে, বিএনপি দীর্র্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ইস্যু ছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য অন্য কোনো ইস্যু খুঁজে পাচ্ছিল না। অতিমারি কোভিড সময়ের শুরুতে ভ্যাকসিন নিয়ে আন্দোলনের পাঁয়তারা দেখা গেলেও এক পর্যায়ে দেখা গেল যে, বিএনপির নেতাকর্মীরা জীবন রক্ষায় আওয়ামী সরকার কর্তৃক সংগ্রহকৃত ভ্যাকসিন গ্রহণ করছেন। ফলে কোভিড বিষয়ে বিরোধী দলের বিরোধিতা বড় আকার নিতে পারেনি। পরবর্তীতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জ¦ালানি সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সংকট, নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির আঘাত বাংলাদেশেও পড়েছে। এতে বিএনপি তার রাজনৈতিক আন্দোলনের ইস্যু খুঁজে পায়। জ¦ালানির মূল্য বেড়ে গেলে রাজপথে হারিকেন নিয়ে আন্দোলন করে এবং দলের শোডাউন করতে পিছপা হয় না। যদিও ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে দলটি উচ্চবাচ্য করেছে, বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির রাজনৈতিক তৎপরতা এনে দিল যেন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সৃষ্ট বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি সংকট। দেশে হঠাৎ করে জ¦ালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের আশায় অপতৎপরতা বেড়ে যায়। পরিবহন মালিকরাও বসে থাকে না। সরকার ভাড়া নির্ধারিত করে দিলেও পরিবহনে সেই ভাড়ায় যাত্রীরা চলাচল করতে পারেন না। চারপাশে যখন সাধারণ জনজীবনে আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পাল্লা ভারি হয়ে নুইয়ে পড়েছে, পরিবেশ পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে ঠিক তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য শুধু সরকারকেই বিব্রত করছে না, বরং রাজনৈতিক খেলার মাঠে বলটা হাতে করে বিরোধী দলের হাতে পৌঁছে দিল যেন। ব্যস, এতেই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন চাঙ্গা করতে বিএনপি চাঙ্গা হয়ে গেল। আন্দোলনের গরম ইস্যু পেয়ে গেল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজের। কেউ বলছেন, দল তাকে ইন্ডিয়াকে তোষামোদ করার দায়িত্ব দেয়নি। কেউবা বলছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্থান রাজনৈতিক দল থেকে নয়, উনি এসেছেন আমলাতন্ত্র থেকে। আওয়ামী লীগকে ধারণ করার ক্ষমতা ওনার থাকার কথা নয়। যারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন তারা ভুলে যান যে, ষাট-সত্তর দশকের আওয়ামী লীগকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, পাওয়া যাবে না এখন। কারণ অন্যান্য দলের মতো এখন আওয়ামী লীগেও আমলা, ব্যবসায়ীরা জায়গা করে নিয়েছে। তাদের রাজপথ থেকে আসতে হয় না। রাজপথ থেকে সবার আসার বিধান যেন আর নেই আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলে। ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী সরকার কিছু ভাবছে কিনা জানা নেই। তবে এ ধরনের বক্তব্য শুধু দলকে নয়, একটি দেশকে তার স্বাধীন সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যেটা কেউ চাইলেই পারে কিনা করতে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। নিশ্চয়ই নয়। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। একজন অভিমত প্রকাশ করলেন, এমন বক্তব্য বিএনপির কোনো নেতা দিলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীর মামলা হয়ে যেত। তাই ক্ষমতাসীন দলের স্বচ্ছতা প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে এই মুহূর্তে। সামনে নির্বাচন। বর্তমান সরকারের অনেক উন্নয়ন এমন ওলট-পালট কথায় ¤øান হয়ে পড়তে পারে জনগণের কাছে। আমরা জানি না যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবেগের আতিশয্যে এ কথা বলেছিলেন কিনা। তবে আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে, প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কথায় মোটেও খুশি হন না, হননি। হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই তার ও তার সরকারকে বিব্রত করার দুঃসাহস, ঔদ্ধত্য তার দলের কারোর থাকতে পারে না। যাই হোক, সরকার একটি দেশের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। যার মূল কাজ হলো রাষ্ট্র ও তার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সরকার তার অস্তিত্বকে ধরে রাখতে অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষী হবে, এটা জনগণ মেনে নিতে চাইবে না, চায় না। এ ধরনের মনোভাব একটি দেশের স্বাধীনতার খ্যাতি, নাম-যশ বিনষ্ট করে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর দিকটি হলো, কেউ যদি নিজ দল ও সমর্থকদের অহেতুক খুশি করার অভিপ্রায়ে এই প্রসঙ্গ বানিয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন। রাজনীতিকদের বক্তব্য প্রদান ও শব্দচয়নে সতর্কতা জরুরি, তা যিনি যেই দলেরই হোন। তবে বেশি সচেতনতা, সতর্কতা জরুরি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী-মিনিস্টার, নেতা ও সাংসদদের।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App