×

জাতীয়

ইয়াসমিন ধর্ষণ-হত্যা: যে ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা দেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২২, ১১:৫১ পিএম

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিবাগত রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি বাসে করে দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় নামে কিশোরী ইয়াসমিন আক্তার। তার বয়স আনুমানিক ১৬ বছর।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো সে। সেদিন ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী একটি বাসে উঠেছিল ইয়াসমিন। দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় একটি পানের দোকানের সামনে সেই কিশোরী অপেক্ষা করছিলেন দিনাজপুরগামী বাসের জন্য। খবর বিবিসির।

দৈনিক ইত্তেফাক

তখন টহল পুলিশের একটি ভ্যান হাজির হয় সেখানে। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি মেয়েটিকে পরামর্শ দেয়, পুলিশের গাড়িতে করে দিনাজপুর শহরে চলে যেতে। কিন্তু পুলিশের ভ্যানে করে সেই কিশোরী দিনাজপুর শহরে যেতে রাজি ছিলেন না। তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন, এতো রাতে তার সেখানে একা থাকা নিরাপদ নয়।

পুলিশের সেই ভ্যানে ছিলেন একজন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ও দুজন কনস্টেবল। শেষ পর্যন্ত খানিকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পুলিশের ভ্যানে ওঠেন ওই কিশোরী। এরপর দিন সকালে কিশোরীটির মৃতদেহ পাওয়া পাওয়া যায় গোবিন্দপুর নামক জায়গায়।

ইত্তেফাক পত্রিকা

তীব্র প্রতিবাদ

এ ঘটনা নিয়ে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সংগঠন বিচারের দাবিতে নানা প্রতিবাদ করতে থাকে। এ খবর ছড়িয়ে গেলে ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দিনাজপুর। বিভিন্ন সরকারি অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে তছনছ করা হয়। দিনাজপুর শহরে কাস্টমস গুদামে মালামাল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিসেও আক্রমণ করা হয়। পরিস্থিতি এতোটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে দিনাজপুর শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিডিআর মোতায়েন করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনাজপুর শহরে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু এই কারফিউকে আমলে নেয়নি সাধারণ মানুষ। কারফিউ উপেক্ষা করেই বিভিন্ন জায়গায় মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এক পর্যায়ে ঘটনার দুদিন পরে এলাকাবাসী কোতোয়ালী থানা আক্রমণ করে সারারাত থানা অবরুদ্ধ করে রাখে। সে সময় কোন পুলিশ সদস্য থানা থেকে বের হতে পারেনি। পরের দিন দিনাজপুর শহরে শতশত মানুষ বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভের মাত্রা এতোটাই তীব্র হয়েছিলে যে পুলিশ মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে এবং তাতে সাতজন নিহত হয়।

নিহত ইয়াসমিন আক্তারের গায়েবানা নামাজে জানাজায় অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের প্রশাসন কার্যত অচল পড়েছিল।

পুলিশের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ

পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ এতোটাই চরমে ওঠে যে পুলিশ সদস্যরা রীতিমতো লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। ১৯৯৫ সালের ২৯শে আগস্ট দিনাজপুর থেকে ভোরের কাগজ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

সেই প্রতিবেদনে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে বর্ণনা করা হয় এভাবে: গোটা শহরটাই যেন প্রেতপুরী। সব পুলিশ কোথায় যেন গা ঢাকা দিয়েছে। আজ শহরে একটি রিকশায় কিছু আসবাবপত্র পরিবহন করতে দেখলে এক পথচারী জানতে চায়, এসব কার মাল? রিকশাচালক উত্তর দেয়, এগুলো পুলিশের না। শহরবাসী আর পুলিশকে বাসা ভাড়া দেবে না।

দিনাজপুর শহরে কর্মরত পুলিশ সদস্যরাও রাস্তায় নামেনি। পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এতোটাই চরমে উঠেছিল যে পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা বিডিআর পাহারার মধ্য দিয়ে দিনাজপুরে শহরে প্রবেশ করেন।

পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারী নিহতের সংখ্যা অন্তত সাতজন বলা হলেও তৎকালীন সরকার দাবি করে নিহতের সংখ্যা তিনজন। অভিযোগ ওঠে, তথ্য গোপনের জন্য পুলিশের গুলিতে নিহত কয়েকজনকে দ্রুত কবর দেয়া হয়।

নিহতদের রক্তমাখা জামা ও মরদেহ শহরের একটি কবরস্থানে রয়েছে বলে খোঁজ পায় কিছু এলাকাবাসী। সেখানে মরদেহ দেখে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও ফুঁসে উঠে। পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সামাল দিতে দিনাজপুর জেলার পুলিশ সুপারকে বদলি করা হয়।

ইত্তেফাক পত্রিকা

একই সঙ্গে দিনাজপুর জেলা থেকে ১০৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং সদস্যকে বদলি করে অন্য জেলায় নেয়া হয়। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রেসনোট প্রচার করে পুলিশ সদস্যদের রক্ষার চেষ্টা করা হয়। উল্টো ঘটনার দায় নিহত ইয়াসমিন আক্তারের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

প্রেসনোটের ভাষ্য ছিল, উপস্থিত লোকজনের অনুরোধে মেয়েটিকে দিনাজপুর শহরে পৌঁছানোর জন্য গাড়িতে উঠিয়ে নেয় পুলিশ। দিনাজপুরে আসার পথে মেয়েটি হঠাৎ করে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যায় এবং জখমপ্রাপ্ত হয়। গাড়ি থামিয়ে মেয়েটিকে ওঠায় পুলিশ। (এরপর) দিনাজপুরে নেয়ার পথে মারা যায় মেয়েটি। তখন পুলিশ দিনাজপুর শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক অফিস রাস্তার পাশে মরদেহ রেখে থানায় গিয়ে খবর দেয় ....

মানুষের ক্ষোভ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) শহরে প্রকাশ্যে আসেননি বেশ কিছু কর্মকর্তা।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটানা ৩৮ ঘণ্টা কারফিউ জারি করে রাখা হয়। কিন্তু তাতে বিক্ষুব্ধ মানুষ দমে যায়নি। এক পর্যায়ে অভিযুক্ত তিনজন পুলিশ সদস্যকে আটক করে রাখা হয়। পরিস্থিতি শান্ত করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে মাইকিং করে জানানো হয়েছিল, পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

ঘটনার চারদিন পরে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর সফরে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, খালেদার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এবার তাকে যেতে হবে।

প্রবল বিক্ষোভের মুখে ঘটনার পাঁচদিন পরে ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির জন্য ইয়াসমিনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। ময়নাতদন্তের পর অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। বিচারের মাধ্যমে তারা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল।

এ ঘটনার ৯ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালে তিনজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App