×

জাতীয়

কুশিয়ারা ফেনী গঙ্গায় জোর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২২, ০৮:২২ এএম

কুশিয়ারা ফেনী গঙ্গায় জোর

ফাইল ছবি

১২ বছর পর কাল থেকে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক > প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে পানি সমঝোতার সম্ভাবনা

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বয়ে চলা অভিন্ন ৫৪টি নদীর অমীমাংসিত ইস্যু, আগাম বন্যার খবর জানতে চাওয়া, কুশিয়ারা-ফেনী নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, ৬টি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি, তিস্তা চুক্তির হালহকিকত ও শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা চুক্তির বিষয় নিয়ে ১২ বছর পর পানিসম্পদমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী দুই দেশ। আগামীকাল মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ে এবং একদিন বিরতি দিয়ে বৃহস্পতিবার পানিসম্পদমন্ত্রী পর্যায়ের এ বৈঠক হবে। জেআরসি বৈঠকে ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। আর নয়াদিল্লির পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত। পানিসম্পদমন্ত্রীদের আলোচনায় নদীর পানির তথ্য ভাগাভাগি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার কথাও চূড়ান্ত হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগামী ৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি সফরে যাবেন। ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের আগে জেআরসি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ আলোচনায় বসতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে পানিসম্পদ খাত যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া ভারত বাংলাদেশকে নদীর পানি-সম্পর্কিত চুক্তিতে একটি প্যাকেজ দিতে সম্মত হয়েছে, যা ঢাকার সঙ্গে নদী সম্পদ ভাগাভাগির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে পরিকল্পনাটি উভয় পক্ষের কর্মকর্তাদের দ্বারা কঠোরভাবে গোপন রাখা হচ্ছে। কারণ দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগির বিষয়টি সবসময়ই সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সেচ ও বন্যা এবং এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যৌথভাবে মোকাবিলা করতে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)। সর্বশেষ ২০১০ সালে জেআরসি বৈঠক হয়েছিল।

জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আগামীকাল মঙ্গলবার দুই দেশের পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ে এবং ২৫ আগস্ট মন্ত্রী পর্যায়ে জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে ঠিক কোন বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১২ বছর পর জেআরসির মতো একটি বিষয় নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করতে পারাটাই হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।

যৌথ নদী কমিশনের এক সদস্য বলেন, জেআরসির পরপরই প্রধানমন্ত্রী ভারত যাবেন। কাজেই জেআরসির এবারের বৈঠকের উদ্দেশ্য বা আমাদের চাওয়া থাকবে অন্ততপক্ষে কুশিয়ারার এমওইউ যেন স্বাক্ষর হয়। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট। ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক খাওয়ার পানি মানবিক কারণে ভারতকে দেয়ার বিষয়ে এমওইউ করলেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। তার মতে, যদি এবার কুশিয়ারা নিয়ে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়, তাহলে রহিমপুর খাল থেকে কৃষিকাজের জন্য আমরা যখন পানি নেয়া শুরু করব, তখন একই সময়ে ফেনী নদী থেকে ভারতে পানি দেয়ার বিষয়ে যে এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছিল, সেটাকে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাব। পাশাপাশি নয়াদিল্লি না চাইলেও আমরা তিস্তা চুক্তির কথাটা বলব এবং মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা চুক্তির কথাও উত্থাপন করা হবে।

জেআরসি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই সমঝোতা স্মারকের আলোকে বাংলাদেশ কুশিয়ারা নদীর পানি রহিমপুর খাল দিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার শুরু করার পর ভারতকে প্রতিদিন ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দেবে। ২০১৯ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে সরবরাহ করা হবে, যাতে সেখানে পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানো যায়। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তির নবায়ন অথবা পর্যালোচনা এবং নদীর ওপর অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়টিও আসতে পারে আলোচনায়। বছর চারেক পর শেষ হতে যাওয়া গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ সময়ভিত্তিক না করার বিষয়েও আলোচনা করবে ঢাকা। আগামী ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। অন্যদিকে ছয়টি অভিন্ন নদী নিয়ে আলোচনায় নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে গুরুত্ব দেয়া হবে বলে ইঙ্গিত রয়েছে। এতে মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি ভাগাভাগির লক্ষ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কাঠামো এবং দুই দেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে একটি সমীক্ষার অগ্রগতি নিয়েও কথা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়ায় পানিসম্পদমন্ত্রী পর্যায়ে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে আলোচিত হবে। দীর্ঘ ১২ বছর পর কমিশনের এই বৈঠক হচ্ছে বলে এর প্রতি সরকারের বেশ আগ্রহ রয়েছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, তিস্তা, গঙ্গা কিংবা ছয়টি অভিন্ন নদীর বাইরে সা¤প্রতিক বর্ষায় দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর পানি বেড়ে তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যার প্রসঙ্গও থাকবে আলোচনার টেবিলে। গত জুন-জুলাই মাসে অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও এর সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে ব্যাপক বন্যার ঘটনা আমলে নিয়ে এ ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধে যৌথভাবে কাজ করতে চাইবে যৌথ নদী কমিশন। মোটা দাগে দুই দেশের পানি সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো আলোচনায় আসবে। কোনোটাতে হয়তো অগ্রগতি আসবে, আবার কোনোটাতে অগ্রগতি না-ও আসতে পারে।

এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকলেও বর্তমানে ১৫-১৬টি নদীর পানি ও বন্যার তথ্য ভারত থেকে নেয়া হয়। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় এবং সিলেট অঞ্চলে নজিরবিহীন বন্যা হওয়ায় এখন থেকে ৫৪টি নদীর পানির তথ্য দেয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে বলা হবে। এসব তথ্য পেলে বাংলাদেশে বন্যারোধে আগাম ব্যবস্থা নেয়া যাবে বলেও জানান তিনি।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের জেআরসিতে তিস্তা প্রসঙ্গ না আনার জন্য বার্তা দিয়েছে নয়াদিল্লি। আর তিস্তাতে অনাগ্রহের ব্যাখ্যায় তারা বলছে, আলোচনায় তিস্তা থাকলে অন্য নদীর ক্ষেত্রে সুরাহা বা বৈঠকে ভালো কিছু হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তবে কি ঢাকার পক্ষ থেকে তিস্তা বাদ দিয়েই আলোচনা হবে জেআরসিতে- এমন প্রশ্নের জবাবে যৌথ নদী কমিশনের এক সদস্য বলেন, যখনই আমরা যৌথ আলোচনায় বসি, সেটা যে সফল হবে তা ভাবা ঠিক হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তার পানি চুক্তি করার জন্য জোর দিয়ে আসছে, যা এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ এর অক্টোবরে ভারত সফর করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২১ সালের মার্চ মাসে ঢাকা সফর করেছিলেন এবং ওই সময় উচ্চ পর্যায়ের মতবিনিময়কালে বাংলাদেশ তিস্তা ইস্যুতে তার গুরুত্বের কথা জানিয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে, ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এর আগে তিস্তা পানি চুক্তিতে বিলম্বের ব্যাখ্যা দেয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে ‘দেশীয় চ্যালেঞ্জ’ উল্লেখ করেছিলেন। যদিও দিল্লি এবং কলকাতার মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক না থাকার কারণে দৃশ্যত তিস্তার পানিচুক্তি স্থগিত রয়েছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন দফায় দফায় বলেছেন, আমরা প্রস্তুত ছিলাম, তারাও প্রস্তুত ছিল। তবুও চুক্তিটি হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারিনি। তবে তিস্তা নিয়ে আমরা আশাবাদী।

ফোকাস অন্যান্য নদী : ২০১০ সালে পানিসম্পদ নিয়ে শেষবারের মতো মন্ত্রী পর্যায়ের জেআরসি বৈঠক হয়েছিল। এরই মধ্যে নদী-সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ইস্যু উভয় পক্ষের মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে, যেগুলোকে একটি সুসংগত নীতিতে আকার দেয়া দরকার হয়ে পড়ছে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কাল থেকে শুরু হওয়া জেআরসি বৈঠকে পানিসম্পদ খাত নিয়ে ‘ইতিবাচক দিকে’ ফোকাস করবে এবং তিস্তার বাইরে ‘অন্যান্য বড় নদীতে’ আলোচনা করবে দুই দেশ। একই সঙ্গে মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা এবং দুধকুমারের মতো নদীতে সহযোগিতা জোরদার করবে, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি নদী রয়েছে এবং ঢাকা উন্নত মৎস্য আহরণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ কৌশলের পরিকল্পনা করার জন্য ভারতের কাছ থেকে আরো তথ্য চায় বাংলাদেশ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত তথ্য ভাগ করে নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে জেআরসির এ বৈঠকে।

প্রসঙ্গত, গত জুনে ভারতের আসামের গুয়াহাটিতে হয়ে যাওয়া নদী সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ভারত ও বাংলাদেশের নদীগুলোর ব্যাপক ব্যবস্থাপনার জন্য একসঙ্গে কাজ করা উচিত। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে যে অভূতপূর্ব বন্যা হয়েছে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনা তথ্য শেয়ার করতে চাই। যদি কোনো সুনির্দিষ্ট উপায়ে, বন্যা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় আমরা বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারি, তাহলে খুব খুশি হব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App