×

মুক্তচিন্তা

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ভয়ংকর ২১ আগস্ট

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২২, ০১:৩৬ এএম

আজ যারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে গলা শুকিয়ে ফেলছেন, জনপ্রত্যাখ্যানে ক্ষমতার সাধ থেকে যারা দীর্ঘদিন বঞ্চিত থেকে গায়-গতরের জৌলুস হারিয়ে ফেলছেন, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না বলে পণ করে বসে আছেন তাদের ক্ষমতাকালীন এ দেশের গণতন্ত্রের যে কী চেহারাখান ছিল তা ভাবতেও বিস্ময় জাগে! গণতন্ত্রকে হত্যার জন্য এরাই সৃষ্টি করেছিল ২১ আগস্ট! আজ ২১ আগস্ট। শেখ হাসিনাকে নির্মমভাবে হত্যাচেষ্টার ১৮ বছর। যাদের বয়স ১৮-র কম তারা দেখেননি, তাদের মনে থাকারও কথা নয়। ২০০৪ সালে যারা শিশু বা কিশোর ছিল- যারা আজ স্পর্ধিত যুবক তাদেরও মনের ভেতর ততটা দাগ কেটে নেই ২১ আগস্ট কী ঘটেছিল বাংলাদেশে? কী ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্য! কারা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল সেদিন? কেনই বা তাকে বারবার হত্যাচেষ্টায় উদ্ধত হয় একটি বিশেষ গোষ্ঠী নতুন প্রজন্মের তা জানা দরকার। গণতন্ত্রের নামে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সূ² কারচুপি তথা ‘ম্যানেজড’ এক নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছিল। ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং বিশেষত হিন্দু ও বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর তাদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মর্মন্তুদ দৃশ্য। লাখ লাখ নেতাকর্মীর নামে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী নিজামী, সাইদী, মুজাহিদ প্রমুখ রাজাকারের বাড়িতে-গাড়িতে পতপত করে উড়েছে লাল-সবুজের পতাকা! গণতন্ত্রের উপহাস দেখে নিষ্ঠুর অপমানে লজ্জিত হয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আর মৃত্যুর ওপার থেকে কী করুণার ব্যঙ্গাত্মক হাসিই না হেসেছেন ৩০ লাখ শহীদ- যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের মহান পতাকা! চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গভবন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল হাওয়া ভবন। অর্থাৎ বঙ্গভবন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাষ্ট্র যতটা পরিচালিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি পরিচালিত হয়েছে হাওয়া ভবন নামক বিশেষ এক আস্তানা থেকে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা নেই গণতন্ত্রের কী বালাই ছিল তখন! দ্বৈতশাসনের ফলে সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতি তৎকালীন সচেতন নাগরিকরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। এক ভৌতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে দেশ! বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি- সব কিছুই দ্রুত ভুলে যায়! হাওয়া ভবনের ইশারা ছাড়া রাষ্ট্রীয় কোনো প্রকল্প অনুমোদন পেত না, আবার অনুমোদিত সব প্রকল্প থেকে নির্দিষ্ট হারে অবৈধ পার্সেন্টেজ চলে যেত হাওয়া ভবনে! ফলে দেশ-বিদেশে লুটপাটের সে টাকার পাহাড় জমেছে! আর সাম্প্রতিককালে বিএনপি যে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে মিডিয়া গরম করছে তাদের জোট আমলের শেষ দিকে যে কী এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করেছিল তাও ব্যথিতচিত্তে মানুষ শুধু প্রত্যক্ষই করেনি, ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রণালি দেখে আশ্চর্য রকমের কৌতুকও অনুভব করেছিল! এসব ভয়ংকর ও কৌতুককর পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটেছিল ১/১১-র সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। তার পরের ঘটনা অনেকেরই জানা। আমরা ফিরে আসি ২১ আগস্টের ঘটনাবলির অন্তর্গত অনুভবে। আমরা বারবারই বলি আগস্ট শোকের মাস। কবিও বলেছেন ‘আগস্ট ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ…’। ১৫ আগস্ট ঘাতকরা আঘাত হেনেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। সপরিবারে তাকে হত্যা করে ক্ষমতালোভী একটি মহল- অভিযানে নেতৃত্ব দেয় উচ্চাকাক্সক্ষী কিছু তরুণ সেনা কর্মকর্তা! এ ঘটনা মেজর জিয়া জানতেন- ‘গো এহেড’ বলে ঘাতকদের পরামর্শও দিয়েছিলেন। সুতরাং ১৫ আগস্টের দায় অন্যান্য অনেকের মতো জিয়াও এড়াতে পারেন না। ৭৫-এর ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্য শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। জননেত্রী রক্ষা পেলেও সেদিন ২৪ জনের মৃত্যু ঘটে! এ হামলার কুশীলবদের মধ্যে তারেক রহমানের নাম তদন্তে বেরিয়ে আসে! শেখ হাসিনা যখন দেশের অসহায় সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতিতে এলেন, তাদের দুঃখ লাঘবের লক্ষ্যে তৎপর হলেন, সাধারণের ভালোবাসায় তাদের হৃদয়-মন জয় করে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে অনন্য অবদান রাখলেন তখন তার জনপ্রিয়তায় বিরোধীদের মধ্যে আশঙ্কা ও আতঙ্ক তৈরি হয়। সমকালে তার মতো জননেতা হয়ে ওঠা অনেকের জন্যই অসম্ভব ছিল। কেউ তার মতো অসহায় নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঔদার্য বা সাহসও রাখতেন না। জাতির পিতার এ গুণটি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তাই শেখ হাসিনাকেও নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল- যুক্ত ছিল কথিত হাওয়া ভবনও। জোট সরকারের দায়িত্ব পালনকারী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও ২১ আগস্ট হামলা মামলার অন্যতম আসামি- বিচারিক রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত! এসব বিস্মৃত হলে চলবে না। বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের দুর্নীতি, কালোবাজারি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার, হত্যা, গুম প্রভৃতি অনাচারের বিরুদ্ধে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ ২১ আগস্ট জনসভার আয়োজন করে। সেই জনসভার মধ্যমণি ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ঘাতকরা তাকে সেখানেই হত্যার টার্গেট করেছিল। সেদিন একটি ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমাবেশের প্রায় শেষদিকে বক্তব্য রাখছিলেন শেখ হাসিনা। আর ফটো সাংবাদিকরা ছবি তুলছিলেন। তার বক্তব্যের প্রায় শেষের দিকে প্রচণ্ড শব্দে একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। অনেকেই তাকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন, রক্ষা পান জননেত্রী। কিছু বুঝতে পারার আগেই অনেকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন কেউবা হাসপাতালের পথে আবার কেউ হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পরাজিত হন। আইভি রহমান তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট প্রাণত্যাগ করেন। আর জনসভায় আগত কত লোক পঙ্গুত্ব বরণ করে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তার সঠিক হিসাব করাও কঠিন! জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই নারকীয় ঘটনায় দেশবাসীর মতো বিশ্ববাসীও থমকে যায়। ঘটনার পরদিন ২২ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরাবাকেন, ভারতের কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ভারতীয় লোকসভার বিরোধীদলীয় নেত্রী এলকে আদভানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রোকা। ২১ আগস্টের নারকীয় এই ঘটনা বিশ্ববাসীও মেনে নিতে পারেনি। তাই এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতীয় দূতাবাস। সবাই হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল : ‘এ ধরনের ঘৃণ্য রাজনৈতিক সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। বিরোধী দলের নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন করার এমন কমান্ডো স্টাইল হামলা সফল হলে এটি গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বিনষ্ট করতো।’ মূলত ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর হামলাকে পশ্চিমা দেশগুলো বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তথা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করায় চারদলীয় জোট সরকারের ওপর ‘চাপ’ তৈরি হয়েছিল। এদিকে ২৪ আগস্ট জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং পরের দিন ২৫ আগস্ট ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসগুলো আবার বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তদন্তে সরকারের ভূমিকায় ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করে, যা তখন ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২১ আগস্ট নিয়ে ব্রিফিংয়ের জন্য বিদেশি দূতদের আমন্ত্রণ জানালে তারা তাতে অংশ নেননি বলে খবরও গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এমন চাপের মুখে ২৫ আগস্ট কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল ডন ম্যাককিনন শেখ হাসিনাকে ফোন করেন তার স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন। এ দিনই অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান সরকারের বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলা হয় ‘এই ঘৃণ্য হামলার ঘটনার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।’ কিন্তু ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ঘটনার তদন্ত নিয়ে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোটের টালবাহানা এবং ‘আইওয়াশ’ বিরূপ সমালোচনা সৃষ্টি করলে ২৬ আগস্ট ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডিন শাহতা জারাবের নেতৃত্বে ১৯ জন কূটনীতিক জননেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা হামলার সুষ্ঠু এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশবাসীর মতো বিদেশি কূটনীতিকদের মনে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল বলে বারবার বিভিন্ন সময় একই আহ্বান শোনা যায়। বিএনপি-জামায়াত এফবিআই ও ইন্টারপোলের সাহায্যে তদন্ত করবে বলে প্রতিশ্রæতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা তা করেনি। উপরন্তু ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে ২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলার মামলাকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করেছে। কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর। সময়ের অগ্নিতাপে যে কোনো মূল্যে ইতিহাস সত্যকেই বের করে আনে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে আজ গ্রেনেড হামলার প্রকৃত আসামিদের অনেকেই বিচারিক প্রক্রিয়ায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। এদের অনেকে আবার পলাতক জীবন বেছে নিয়ে বিদেশে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু ইতিহাস এও প্রমাণ করেছে যে, জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিরলস কাজ করেন বলেই সাধারণ মানুষও তাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে- তাকে নিয়েই এ দেশের মানুষ এগিয়ে যেতে চায়। বিএনপি-জামায়াত ছাড়া এ দেশের সব মানুষের এ বিশ্বাসই বদ্ধমূল যে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতেই এ দেশ যেমন নিরাপদ তেমনি দেশের গণতন্ত্রও তার প্রচেষ্টায়ই বিকাশে উন্মুখ। ২১ আগস্ট ছাড়াও ২০ বারের অধিক শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ শুধু আগস্টই নয় জননেত্রীর জন্য প্রায় প্রতিটি দিনই ঝুঁকিপূর্ণ! কিন্তু বারবার তিনিই কেন ঘাতকদের টার্গেট হবেন? বিবেকসম্পন্ন তরুণ প্রজন্মের মনে সে প্রশ্ন জাগ্রত হওয়াও জরুরি। কেননা তরুণরাই অন্ধকারের অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করে দেশকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App