×

জাতীয়

সামাজিক অপরাধ বেড়েছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২২, ০৮:৩৮ এএম

সামাজিক অপরাধ বেড়েছে

ফাইল ছবি

** জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব বাজারে ** জনজীবনে সংকট বেড়েছে ** অনেকে জড়াচ্ছেন অপরাধে **

জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ার কারণে বেড়েছে গণপরিবহনের ভাড়া ও পণ্য পরিবহনের ব্যয়। এর প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারসহ জনজীবনের সর্বত্র। বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে কাজ ও চাকরি হারিয়ে অনেকে বেকার হয়ে পড়েন। এর মধ্যে দাম বাড়ার চাপে মানুষের জীবনে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বেগতিক পরিস্থিতিতে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। সাম্প্রতিক সময়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে এমন চিত্র ফুটে ওঠে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, বাজারের চাপ সামলাতে অনেকে অপরাধের পথে পা বাড়াবেন। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়বেন কেউ কেউ। এটাই সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা। গত ১১ আগস্ট রাতে উত্তরায় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথে ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় ধৃত ব্যক্তি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, অভাবের সংসারে নিরুপায় হয়ে অপরাধে জড়িয়েছেন তিনি। এমন ঘটনার পর গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে ভাবছেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সব ইউনিটকে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, একক কোনো কারণ না হলেও অপরাধের পেছনে অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্বপূর্র্ণ। সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া বা অর্থনৈতিক কারণে অপরাধে জড়ানোর মতো কোনো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়।

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপেট সারাবিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে কের্ড পরিমাণ। অনেক দেশ পড়েছে মন্দার কবলে। তার ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে জীবনযাত্রা।

বিশ্লেষকদের মতে, জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সামাজিক অপরাধ প্রবণতার যোগসূত্র রয়েছে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সরাসরি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় এমন অপরাধ; যেমন- চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অজ্ঞান ও টানা পার্টির মতো অপরাধ বেড়ে যায়। আর এ অপরাধগুলো নগরকেন্দ্রিক বেশি দেখা যায়। তাই এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। প্যাট্রলিংসহ নজরদারি ব্যবস্থা বড়াতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সমাজের মানুষের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী বিকল্প ব্যবস্থার বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে। করোনাকালে আমরা সরকারসহ সমাজের ওপরের স্তরের মানুষকে নানামুখী উদ্যোগ নিতে দেখেছি।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান গতকাল শুক্রবার বিকালে এ বিষয়ে বলেন, অর্থাভাবে মানুষ অপরাধের দিকে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ যাতে সেদিকে না যায় সেজন্য ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ সব ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছেন। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই যাতে না হয় সেদিকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশ ও বিট পুলিশকে জনসচেতনতা বাড়িয়ে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

অভাবজনিত কারণে অপরাধে জড়ানোর নজির আবদুস সামাদ। তার ঘটনাটি সমাজে নাড়া দিয়েছে। গত ১১ আগস্ট রাতে উত্তরায় এটিএম বুথে খুনের ঘটনায় আটক হন আবদুস সামাদ (৩৮)। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, কোনো কাজ নেই, সংসার চালানো মুশকিল, সেই সঙ্গে এলাকায় অনেকটা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন- কোনো উপায় না পেয়ে ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আগে তিনি কোনো অপরাধে জড়িত ছিলেন না।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, অভাবের কারণে দুই ধরনের অপরাধ বাড়ে। প্রথমত, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন ও দ্বিতীয়ত, পরিবারে অশান্তি। প্রথমটি যাতে না বাড়ে সেজন্য পুরনো অপরাধীদের তথ্যভাণ্ডার কাজে লাগানো হচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার ও নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। কেননা চুরি-ডাকাতির জন্য ওস্তাদ লাগে, প্রশিক্ষণ লাগে। পুরনোদের ধরলে অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যায়। আর পারিবারিক সহিংসতার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ আছে। সেখানে আসা কলগুলোর বিষয়ে পুলিশ অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছে। যাতে পারিবারিক বিরোধ প্রাণহানি পর্যন্ত না গড়ায়।

এদিকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও পারিবারিক কলহ বেড়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এসব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে- তাদের নামে থানায় পূর্বে অভিযোগ ছিল না। বাজার পরিস্থিতির কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। পুলিশের কাছে খবর রয়েছে, মাসের খরচের চাপ সামলাতে অনেকে পরিবার শহর থেকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কয়েকদিনে রাজধানীতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও ছিনতাই ও টানাপার্টির শিকার হয়েছেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে যাওয়া ও কর্মহীনতা অপরাধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। যার প্রমাণ, করোনায় মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ার পরও সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং বেশকিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অপরাধ বেশি দেখা গেছে। এর প্রধান কারণ ছিল কর্মহীনতা। গত বছর নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর কয়েক প্রকার অপরাধ বেড়ে যায়। এর পেছনে কাজ করেছে করোনাকালে মানুষের আয়ে ধাক্কার রেশ ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। সেখানে এবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হলো। বিদ্যমান বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা রয়েছে তীব্রভাবে। পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, টানাপড়েনের সংসারে মানসিক চাপ বাড়ায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠে মানুষ। এমন অবস্থায় খুন, সংঘর্ষ, নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে যায়। এ অবস্থায় বিভিন্ন পক্ষ সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষকে অশান্ত করে তোলার চেষ্টা করতে পারে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩ নভেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এর আগের ৮ মাস (মার্চ-অক্টোবর ২০২১) থেকে পরের ৮ মাসে (নভেম্বর-জুন ২০২২) ঢাকা মহানগরীতে অপরাধ বেড়ে যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, পূর্বের ৮ মাস থেকে পরের ৮ মাসে তিন হাজার ৬১টি মামলা বেশি হয়েছে। চুরির সংখ্যা বেড়েছিল ১৮৬টি। এর মধ্যে গাড়ি চুরির ঘটনা আগের চেয়ে ২৯টি বেশি ছিল। অপরাধ বাড়ার তালিকায় ছিল অপহরণ ও সিঁধেল চুরি। এই সময়ে মাদকদ্রব্য উদ্ধার মামলা দুই হাজার ১৭৯টি ও চোরাচালান ৫০টি বেশি রেকর্ড করা হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App