×

জাতীয়

ট্রাকের নিচের গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হলে নেত্রীসহ কেউ বাঁচতাম না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২২, ১১:৫৭ পিএম

ট্রাকের নিচের গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হলে নেত্রীসহ আমরা কেউ বাঁচতাম না মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেছেন, সেদিনের গ্রেনেড হামলা আমার কাছে অলৌকিক ব্যাপার মনে হচ্ছিল। এত বড় একটা মিটিং। সেই মিটিংয়ে এভাবে অতর্কিত হামলা হতে পারে, এটা ছিল আমার চিন্তার বাইরে। আর যেহেতু এটা সরকারের মদতেই হয়েছে, সেক্ষেত্রে সরকারের যে সব ধরনের সমর্থন ছিল, তা স্পষ্ট। ফলে তারা এই ঘটনা ঘটাতে সাহস পেয়েছিল। তাদের হয়তো আগেই সব ধরনের সাপোর্টের আশ^াস দেয়া হয়েছিল। নইলে এই সাহস তারা পেত না। আর হামলাকারীরা যাতে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে সে কারণেই হয়তো লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়। নইলে তারা বেরিয়ে যেতে পারত না। এই গ্রেনেড হামলার ফলে আমরা বুঝতে পারলাম, এই সরকারের (তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট) কাছে আমরা কেউ নিরাপদ নই। ট্রাকের নিচে যে গ্রেনেডটা ছিল, তা বিস্ফোরিত হয়নি। যেটা শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে মারা হয়েছে, সেটা যদি বিস্ফোরিত হতো তাহলে নেত্রীসহ আমরা কেউ বাঁচতাম না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেটা বিস্ফোরিত হয়নি। সে কারণে আমরা সবাই বেঁচে যাই। পরে তাকে লক্ষ্য করে যে গুলি ছোড়া হয়েছে সেটাও তার শরীরে লাগেনি। যার কারণে তিনি বেঁচে গেছেন। গতকাল শনিবার নিজ বাসভবনে ২১ আগস্ট নিয়ে ভোরের কাগজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।

আমির হোসেন আমু বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বিশ^বাসীর কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল যে এটা সরকারি মদতেই হয়েছে। সরকার সেদিন পার্লামেন্টেও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দেয়নি। স্পিকার মাইক বন্ধ করে দিয়েছিল। এরকম একটা ঘটনায় সারাবিশ্ব যখন অবাক, সেই জিনিসটা দেশের পার্লামেন্টে আলোচনা হবে না- সেটা কী করে হয়। কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। এভাবে প্রতিটি পদক্ষেপেই তারা প্রমাণ করেছে যে এই ঘটনা সরাসরি তাদের মদতেই হয়েছে। তাদের হস্তক্ষেপেই হয়েছে। আমরা বুঝতে পেরেছি যে এই সরকারের সময়ে আমরা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন। তাই শেষবারের মতো আমরা আন্দোলনে নেমে পড়ি। যেভাবেই হোক খালেদা-নিজামীর সরকারকে হঠাতে হবে। তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না, সেটা তারা প্রমাণ করেছে। যার ফলে ১/১১ হয়েছে। পরবর্তীকালে ১/১১ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করে। যদিও ১/১১ এ যারা সরকারে ছিল, তারাও কিন্তু সবাই বিএনপির পছন্দের লোক। তারা সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিল যে খালেদা জিয়া সেই সরকারের অভিষেকে কেন আসেনি। তিনি আসলে হয়তো ব্যাপারটা অন্যখানে প্রবাহিত হতো। তার কারণ ফখরুদ্দিন খালেদা জিয়ার পছন্দের, তাদের আমলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিল। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম মেয়াদের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর চেয়ারম্যান। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তাদের সমর্থন নিয়েই সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি হন। এভাবে যারা ছিল সেই সরকারে, তারা সবাই বিএনপি মনা। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি সব বিএনপির পক্ষেই ছিল। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যিনি ছিলেন প্রতিদিন তার লেখা দিনকাল পত্রিকায় প্রকাশি হত। তার বক্তব্যেও পরিষ্কার ছিল, সে কোন পন্থি। তারা সবাই বিএনপির। কিন্তু বিএনপির কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তারা অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে, ফলে তারা ভোটে জিততে পারেনি।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে গ্রেনেড মেরে হত্যা, শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার, খুলনার মঞ্জুরুল ইসলাম, সিলেটে কামরানের ওপর হামলা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলাসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করা হয়েছে। এই সিরিজ হামলার প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট একটা প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছে আওয়ামী লীগ। এটা করার কথা ছিল মুক্তাঙ্গনে। কিন্তু সেখানে পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। বাধ্য হয়ে আমরা সমাবেশটি আমাদের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে করি। সভা সংক্ষিপ্ত ছিল। সময়ও বেশি পাইনি। তাই মঞ্চ করা সম্ভব হয়নি। ট্রাকেই অস্থায়ী মঞ্চ করে সেখানে বেলা আড়াইটায় আমরা সমাবেশ শুরু করি। আড়াইটার আগে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আমাকে ফোন করে জানাল মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করতে পুলিশ বাধা দিচ্ছে। তাই আমরা পার্টি অফিসের সামনে সমাবেশ করব। আপনি একটু আগেই চলে আসেন। আমি আগেই গেলাম। এরপর নেতাদের অনেকেই আসা শুরু করছে। বেলা পৌনে ৩টার দিকে সভার কাজ শুরু হয়ে গেল। মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথমে বক্তব্য রাখলেন। এরপর ঠিক হলো যে শুধু প্রেসিডিয়াম মেম্বাররা আর সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য দেবেন। সাজেদা আপা (সাজেদা চৌধুরী) আর তোফায়েল সাহেব ছিলেন না। আমাদের বক্তব্য শেষে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ সভার সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন। তার বক্তব্য যখন শেষ পর্যায়ে তখন আমাদের নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মঞ্চে আসলেন। মঞ্চে উঠতে উঠতে নেত্রী বললেন যে আজকে পথে এত ভিড়, এত লোক....যে গাড়ি আসতে পারছিল না, তাই আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।

তিনি বলেন, নেত্রী বক্তব্য শেষ করলেন। তিনি যখন মঞ্চ থেকে নামবেন, ঠিক সেই সময় একজন ফটো সাংবাদিক বললেন ‘আপা আমরা ছবি নিতে পারিনি’। তিনি দাঁড়াবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে টার্গেট করে গ্রেনেড হামলা শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা মঞ্চে ছিলাম, হানিফসহ নেত্রীকে মানবঢাল করে তাকে রক্ষা করা হলো। তখন তো বুঝতে পারিনি, যে নেত্রী কতটুকু রক্ষা হচ্ছে। প্রথম শব্দের পর যখন শব্দ থামল, তখন নেত্রীকে মঞ্চে থেকে নামিয়ে আনা হলো। নামার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু হলো। গাড়িতে গুলি লেগেছে, বুলেটপ্রুফ হওয়ায় নেত্রীর গায়ে গুলি লাগেনি। এরপর আবার গ্রেনেড হামলা। এভাবে পরপর তিন বার বিরতি দিয়ে গ্রেনেড ছোড়া হলো। আমিসহ মঞ্চের অনেকেই ট্রাকে মাথা নিচু করে শুয়ে পড়লাম। গ্রেনেডের শব্দ থামার পর টিয়ারশেল মারা পাশাপাশি নেতাকর্মীদের লাঠিচার্জ শুরু হয়ে যায়। আমাদের যখন ট্রাক থেকে নামিয়ে আনা হয়, তখন দেখলাম মঞ্চের সামনে অগণিত মানুষ মাটিতে পড়ে আছে। তারা কাতরাচ্ছে। রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে। হাজার হাজার জুতা পড়ে আছে। আমার ধারণা ২ শতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় পড়ে ছিল। এর আগে অনেককেই হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। অনেককেই হাসপাতালে নেয়ার পথে। আমাকে যখন হাসপাতালে নেয়ার কথা বলা হলো, তখন আমি বলেছি যে আমার চেয়ে যারা বেশি আহত আগে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাও। তিনটা গাড়ি ছেড়ে গেল আহতদের নিয়ে। এরপর এডভোকেট সাহারা খাতুন তার নিজের ছোট একটা জিপ নিয়ে আসল, আমি সেই গাড়িতে উঠলাম। মেডিকেলে যখন গেলাম তখন শুনলাম যে হাসপাতালে কোনো জায়গা খালি নাই। দ্বিতীয়ত আহতদের চিকিৎসা দেবে, সেরকম কোনো ডাক্তার নাই। সব ডাক্তার সরে গেছেন সরকারের নির্দেশে। এরপর শমরিতায় গেলাম, সেখানেও কোনো জায়গা নেই। তখন বাসা থেকে বারবার ফোন করছিল। বাসায় কান্নাকাটি যে আমি বেঁচে আছি কিনা। আমি বাসায় চলে আসলাম। এরপর উত্তরায় আমার খালার একটা ক্লিনিক আছে, সেখানে আমাকে নিয়ে যায়। আমার শরীর থেকে কিছু গ্রেনেডের স্পিøনটার বের করা হলো। পরে বলা হলো বাকি যেগুলো আছে, সেগুলো আমরা বের করতে পারব না। অন্য ডাক্তার দিয়ে বের করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App