×

অর্থনীতি

সিন্ডিকেটের কবলে ডিমও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৯:০০ এএম

সিন্ডিকেটের কবলে ডিমও

ডিমের বাজার। ফাইল ছবি

ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান ও জরিমানা

ডিম সব সময় স্বল্প আয়ের মানুষের হাতের নাগালেই ছিল। কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে দেয় অসাধু মুনাফার কারসাজি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে সেই ডিমও হঠাৎ করেই চলে যায় নাগালের বাইরে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি হালি ডিমে এক লাফে দাম বেড়ে যায় ১২ থেকে ১৩ টাকা পর্যন্ত। দফায় দফায় বেড়ে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৬০ টাকা বা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। যা এ যাবৎকালের মধ্যে ডিমের সর্বোচ্চ দাম। এ অবস্থায় বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দাম কমানোর স্বার্থে প্রয়োজনে ডিম আমদানির কথা বলেন। এমন বক্তব্যের পর একদিনের ব্যবধানে ডিমের দাম হালিতে ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা কমেছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতি ডজন ডিম ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া গেছে। যদিও স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় এ দাম অনেক বেশি। তবে দুদিন আগের তুলনায় দাম কমেছে।

ব্যবসায়ীরা ও উৎপাদনকারীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত কিছু দিন ধরেই মুরগির খাদ্য উপকরণের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। এছাড়া করোনাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডিমের উৎপাদন আগের চেয়ে কমেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে ডিমের দামের ওপর। তবে এর সঙ্গে যুক্ত করে খামারিরা বলেছেন, ডিমের দাম বেড়েছে এটা সত্যি। কিন্তু খামারিরা এত বাড়তি দাম পাচ্ছেন না।

এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ সিন্ডিকেট ডিমের দাম এতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে, হঠাৎ ডিম-মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা সরজমিন দেখতে পায় ডিম ও মুরগির দাম ব্যবসায়ীরা মনমতো বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রি করছেন। আড়তদাররা মফস্বল থেকে বেশি দামে কিনে এনেছেন বলে দাবি করলেও গ্রামগঞ্জের মোকাম থেকে বাড়তি দামে ডিম কেনার কোনো রশিদ দেখাতে পারেনি। খুচরা ক্রেতাদের বাড়তি দামে ডিম বিক্রির কোনো রশিদ দেয়নি আড়তদাররা। তাদের বিক্রির কোনো মূল্য তালিকাও নেই। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর খিলগাঁও কাঁচাবাজারে আসা নিহাদ কবির বলেন, উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগেই স্বল্প আয়ের মানুষের প্লেট থেকে গরুর মাংস উঠে গেছে। এবার ডিমও উঠে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। নিহাদ কবির বলেন, পুষ্টির চাহিদা মেটাতে আগে বাচ্চাকে সকালে একটা ডিম খাওয়াতাম। কিন্তু এখন সেটা আর সম্ভব হবে না। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য-বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২২ অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি ডিম উৎপাদন হয়। দেশে উৎপাদিত ডিম দিয়েই চাহিদা মেটে। পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ লাখ ডিমের চাহিদা। কুরবানির ঈদের পর এখন সে চাহিদা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। কিন্তু সেই চাহিদামতো ডিমের সরবরাহ নেই।

রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে গতকাল বৃহস্পতিবার দেখা গেছে, লাল ও সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে হালিপ্রতি ৫০ টাকা করে, যা বুধবার ছিল ৫৫ টাকা। কোথাও কোথাও ৬০ টাকা হালিতেও বিক্রি হয়েছে। সে হিসাবে খুচরা বাজারে একদিনের ব্যবধানে হালিপ্রতি ডিমের দাম কমেছে ৫ থেকে ১০ টাকা। তবে যারা ডজন কিংবা এক কেস ডিম কিনছেন তারা আরো কম দামে কিনতে পারছেন। এক্ষেত্রে ডজনে ৫ থেকে ১০ টাকা কমে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় কিনতে পারছেন তারা। বাজারগুলোতে লেয়ার মুরগির ডিমের দাম কমলেও দেশি মুরগি কিংবা হাঁসের ডিমের দাম কমেনি। হাঁসের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায়। দেশের বাজারে ডিমের হালি ৫০ টাকা হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি টাকায় ২৫ টাকার আশপাশে (১ রুপি সমান ১ টাকা ২০ পয়সা ধরে)। পার্শ্ববর্তী আরেক দেশ পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি শহরে ফার্মের মুরগির ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ২০৮ পাকিস্তানি রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৪ টাকার মতো। সে হিসাবে প্রতি হালি ডিমের দাম দাঁড়ায় প্রায় ৩১ টাকা। অর্থাৎ কলকাতা ও রাওয়ালপিন্ডির তুলনায় ঢাকায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে ডিম।

রাজধানীতে ডিম সরবরাহের অন্যতম বড় জায়গা তেজগাঁও ডিমের আড়ত। প্রায় ৪৫ বছরের পুরনো এই আড়ত থেকে রাজধানীর অধিকাংশ জায়গায় ডিম সরবরাহ হয়। ডিমের মূল্য নির্ধারণের জন্য সেখানে রয়েছে সমিতি। প্রতিদিনই ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়। তবে সমিতির বেঁধে দেয়া দামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাড়তি দামে ডিম বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বেশি হওয়ায় খুচরা বাজারেও দাম বেড়েছে।

মতিঝিল, কমলাপুর, আরামবাগে পাইকারি ডিম সরবরাহ করেন আব্দুল ওয়াহাব। তিনি বলেন, তেজগাঁও ডিমের আড়ত থেকে ডিম আনেন তিনি। সেখানে দর বেশি হওয়ায় দোকানেও বেশি দামে দিতে হয়। আব্দুল হাদী বলেন, গত মাস থেকেই ডিমের দাম বাড়তি। প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। হাদী আরো বলেন, আড়তে ডিমের দাম ঠিক করে দেয় সমিতি। কিন্তু সমিতির দামে ডিম বিক্রি হয় না। তারা যে দাম ঠিক করে তার চেয়ে শ-তে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা বেশি দামে কেনা লাগে। একই তথ্য জানিয়েছেন খিলগাঁও মালিবাগ এলাকায় ডিম সরবরাহকারী আরিফুর রহমান।

এদিকে ব্রয়লারের খামারিদের ভাষ্য, ব্রয়লারের খাবারের দাম বেশি হওয়ায় ডিম ও মুরগি দুটির দামই বেশি। পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসিন এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে তাদের সংগঠনের যৌথভাবে করা একটি সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০১০ সালে দেশে খামারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৬৩টি। কিন্তু এখন খামারের সংখ্যা কমতে কমতে ৭৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, মুরগির বাচ্চার চাহিদা কমে গেছে। ফলে অনেক হ্যাচারি তাদের কাছে থাকা ডিম বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু এখন ডিমের চাহিদা বাড়ায় অনেক খামার চালু হয়েছে। আবার অন্যদিকে হ্যাচারিগুলোতেও ডিমের চাহিদা বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে ডিমের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে ভুট্টা আমদানি কমেছে। এতে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ১৭ টাকা কেজির ভুট্টা এখন ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। আর সয়াবিন মিলের ৩২ টাকা কেজি থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ খাতের একজন উদ্যোক্তা বলেন, ডিমের দাম বাড়লেও খামারিরা খুব বেশি লাভবান হচ্ছেন না। কারণ, এর মধ্যে একটি সিন্ডিকেট ডিমের দাম বাড়াচ্ছে। তাদের বেঁধে দেয়া দামের কমে আড়তগুলোতে ডিম বিক্রি হয় না।

ভোক্তা অধিদপ্তরের জরিমানা : চলমান দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে তেজগাঁও ডিমের আড়ত ও কারওয়ান বাজার মুরগির আড়তে গতকাল বৃহস্পতিবার অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় ডিম ও মুরগির দাম ব্যবসায়ীরা মনমতো বাড়িয়ে চলেছে বলে প্রমাণ মেলে। আড়তগুলো গ্রামগঞ্জের মোকাম থেকে বাড়তি দামে ডিম কেনার কোনো রশিদ দেখাতে পারেনি। এছাড়া তারাও বাড়তি দামে ডিম বিক্রির কোনো রশিদ দেয়নি খুচরা বাজারের ক্রেতাদের। এসব অভিযোগে তেজগাঁও এলাকায় দুটি ডিমের আড়তকে ও কারওয়ান বাজারে একটি মুরগির দোকানকে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ হাজার টাকা সতর্কতামূলক জরিমানা করা হয়। অভিযান পরিচালনা করেন ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হাসানুজ্জামান এবং সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল। হাসানুজ্জামান বলেন, ডিমের আড়তে বিক্রেতা কী দামে কিনেছেন তার কোনো রশিদ নেই। তাদের বিক্রির কোনো মূল্য তালিকাও নেই। আবার যার কাছে বিক্রি করছেন তাদেরও কোনো রশিদ দিচ্ছেন না। সম্পূর্ণ পেপারলেস বিজনেস।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App