×

জাতীয়

নিরাপত্তাহীন নির্মাণের খেসারত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২২, ০৮:৪৩ এএম

নিরাপত্তাহীন নির্মাণের খেসারত

ছবি; ভোরের কাগজ

** বিআরটি প্রকল্প এলাকায় অবহেলার এক দশক ** প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে **

রাজধানীর উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডারে বারবার হতাহতের ঘটনা পরও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো জোরদার করা হয়নি। এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের শুরুতেই নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলেও বিআরটি কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে চরম অবহেলা ও উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ঢাকার উত্তরা ও গাজীপুরে একের পর এক দুর্ঘটনার পরও প্রকল্পের কোনো অংশেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর বিআরটি কর্তৃপক্ষ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। যার খেসারত দিতে হয় নিরীহ মানুষকে। সর্বশেষ গত সোমবারের ঘটনার পরও বিআরটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে তদন্ত কমিটি নিরাপত্তায় ঠিকাদারের গাফিলতি পেয়েছে।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে এই অংশে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়ার পর বিআরটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। গতকাল প্রকল্পের উত্তরা অংশের কোথাও কোনো কাজ চলতে দেখা যায়নি। বিআরটির মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে বলেছেন, নিরাপত্তার ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি খামখেয়ালিপনা করেছে।

উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রকল্পের নির্মাণকাজের চলমান অংশ ঘুরে দেখা যায়, ১০ বছর ধরে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় প্রকল্পের কাজ চলেছে। সোমবারের হতাহতের ঘটনার পর প্রকল্প এলাকায় এক চুলও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়নি। গার্ডার বহন করা ঘাতক ক্রেনটি ঘটনাস্থলের পাশেই রাস্তার ওপর রয়েছে। গার্ডারটি সামান্য একটু মাঝখানের দিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ব্যস্ততম এই সড়কের উভয় পাশ দিয়ে স্বাভাবিক সময়ের মতো হাজার হাজার যানবাহন রাস্তার মাঝখানে রাখা ক্রেন, গার্ডার, স্লাব, কংক্রিটের ব্লক ও অন্যান্য মালামাল ঘেঁষেই চলাচল করছে। কিন্তু সড়কের কোথাও কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখা যায়নি।

প্রকল্পের আব্দুল্লাহপুর অংশে উপরের স্প্যান বসানোর পর ব্রিজের কাজ উপরের অংশেই চলছে। নিচের রাস্তা একেবারেই ফাঁকা, কোনো কাজ চলমান নেই। উপরে কাজ চললেও নিচ দিয়ে অবাধে হাজার হাজার যানবাহন ও মানুষ চলাচল করছে। কিন্তু এখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। উপর থেকে পাথর বা অন্য কোনো কিছু নিচে পড়ে আবারো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আব্দুল্লাহপুর মোড়ের দক্ষিণ পাশে স্প্যান বসানোর কাজ চলছে। এরপরের অংশের হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তায় বিআরটিএর কোনো কাজ না চলায় রাস্তা ফাঁকা, নির্বিঘ্নে চলছে যানবাহন। হাউজ বিল্ডিং এলাকায়ও নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া ওপরের অংশের কাজ চলছে। এই অংশের সেতু অংশের ভায়াডাক্ট রাজউক স্কুল এন্ড কলেজের সামনে গিয়ে নেমেছে। এখানেও কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয়নি। এখান থেকে আজমপুর থেকে জসিমউদ্দিন রোডের মোড় পর্যন্ত অংশে প্রকল্পের কাজ চলছে। রাস্তার মাঝখানে অনেক বক্স গার্ডার ও অন্যান্য মালামাল রাখা হয়েছে। এই আজমপুরেই গত সোমবার গার্ডার গাড়ির ওপর পড়ে পাঁচজন নিহত হন। কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় গার্ডার ওঠানোর সময়ও ক্রেনের কাছ ঘেঁষে যানবাহনগুলো চলাচল করছিল। জসিমউদ্দিন মোড়ের দক্ষিণ পাশ থেকে বিমানবন্দর সংলগ্ন উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের জামে মসজিদ পর্যন্ত সড়কে বিআরটি প্রকল্পের কোনো কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে মসজিদের পর থেকে জিএফ ট্রেডিং ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে ব্লক, স্ল্যাব ও বালুসহ নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে। এখানেও কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয়নি। দিনের পর দিন ব্যস্ত সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রেখেই গার্ডার ওঠানোর কাজ চলেছে। নির্মাণকারীদের অবহেলা ও খামখেয়ালিপনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। জসিমউদ্দিন এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শমসের আলী বলেন, মেট্রোরেলের কাজের সময় নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে তারপর কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু বিআরটি প্রকল্পের কাজের ক্ষেত্রে আমরা কখনই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেখিনি। দিনে এবং রাতের বিভিন্ন সময় গার্ডার ও স্প্যানগুলো সেতুতে তোলা হচ্ছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে এতো অবহেলা আর দেখিনি।

জসিমউদ্দিন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আতাহার ইউসুফ বলেন, নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখনো যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, তাহলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

ঘটনাস্থলে মেয়র ও বিআরটির এমডি : এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ রাখতে বিআরটি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈঠকের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার বিআরটি কর্মকর্তাদের নগর ভবনে ডেকেছেন মেয়র। ওই বৈঠকে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর কাজ শুরু হবে। মেয়র আতিক বলেন, খামখেয়ালির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। সড়কে নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার পর সড়কে কাজ করা যাবে।

অন্যদিকে বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুল ইসলাম দুর্ঘটনার দায় ঠিকাদারের ওপর চাপিয়েছেন। তিনি বলেন, ঠিকাদার খামখেয়ালিপনা করেছে। আমরা আগে থেকেই তাদেরকে নিরাপত্তা জোরদার করতে বলেছি। তারা কথা শোনেনি। আমরা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

তদন্ত কমিটির বক্তব্য : গার্ডার পড়ে পাঁচ যাত্রী নিহতের ঘটনায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। গতকাল সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি।

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তার বলেন, এ দুর্ঘটনায় প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) দায় আছে। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার লঙ্ঘন করেছে। এ বিষয়ে ঢাকার চীনা দূতাবাসকে আমরা জানাব। তিনি বলেন, আমাদের এ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকবার লঙ্ঘন করেছে। এজন্য আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে জানাতে চাই।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নীলিমা আক্তার বলেন, আমি এক কথায় বলতে চাই, দায় এড়ানোর প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের নাগরিকদের মূল্যবান জীবন চলে গেছে, এক্ষেত্রে আমরা কোনো রকম ‘ক¤েপ্রামাইজ’ করতে চাই না। কে দায়ী, সেটা স্টেপ বাই স্টেপ আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সবগুলোর সঙ্গে একটা লিগ্যাল কানেকশন আছে। সে জিনিসগুলো আমাদের ফলো করতে হবে। এটা ভাবার কারণ নেই, আমরা একটা চাইনিজ কোম্পানিকে দায়ী করে আমাদের দায় ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের নাগরিকের জীবন মূল্যবান। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এটা এভাবে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে?

অতিরিক্ত সচিব আরো বলেন, আমাদের কাজটি (বিআরটি প্রকল্পের একপ্রেসওয়ে) প্রায় ৮০ ভাগ হয়ে গেছে। এখন আমরা শাস্তি দিতে পারি, তাদের বাতিল করে দিতে পারি। সেক্ষেত্রে আমরা যদি পুনরায় কন্ট্রাক্টর সিলেকশনে যাই, তাহলে আমাদের জনগণকে ভোগান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হবে। কিন্তু ভোগান্তি এক জিনিস, আর লাশ দেখা আরেক জিনিস। সেজন্য আমরা আর কম্প্রোমাইজ করছি না।

সংবাদ সম্মেলনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বলেন, সড়ক নিরাপত্তা যে কোনো কনস্ট্রাকশন কাজের অন্যতম সেফটি ইস্যু। এগুলো ছাড়া কোনো চুক্তি হয় না। চুক্তির মধ্যে আছে ঠিকাদার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ইস্যুগুলো নিশ্চিত করার পরই কেবল কাজে যেতে পারবে। সেগুলো কনফার্ম করেছে কিনা, সেটি যাচাই করার জন্য কনসালট্যান্ট আছে, প্রজেক্ট পারসন আছে। তারা সেফটি মেজারমেন্টগুলো যাচাই করবে। এছাড়া প্রকল্পের মধ্যে আলাদা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টশন ইউনিট আছে। দাতা সংস্থা এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) কনসালট্যান্টও আছে। তারাও বিষয়গুলো মনিটর করে।

ঠিকাদারকে আসামি করে মামলা : সোমবার গার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে পাঁচজন নিহতের ঘটনায় বিআরটির নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে এখনো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাউকে ডাকা বা আটক করা হয়নি।

সেভ দ্য রোড নামের একটি সংগঠন জানায়, বিআরটি প্রকল্পের পরামর্শক হচ্ছে ‘স্মেক’ নামের একটি অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠান। স্মেক প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয় চীনের প্রতিষ্ঠান জিয়াংসু প্রোভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (জেডটিইজি) নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। ঠিকাদারের বর্তমান কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড যথেষ্ট না হওয়ায় আই গার্ডার নির্মাণ ত্বরান্বিত হচ্ছে না। তাছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রিকাস্ট বক্স গার্ডার নির্মাণের কাজ দেরিতে শুরু করেছিল। এতে কাজ শেষ করতেও দেরি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পিয়ার হেড নির্মাণে ধীরগতির কারণে আই গার্ডারের ইরেকশনের কাজেও ভাটা পড়ে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময়ে বক্স গার্ডার পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে ‘পিয়ার হেড’ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ বক্স গার্ডারে পরিবর্তন এলে পিয়ার হেডের ডিজাইনে পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়ে। প্রকল্পের কাজে গতি না থাকার কারণ উল্লেখ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্মেক লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিল, ভূগর্ভে ও মাটির ওপরে বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি লাইন থাকায় অনেক স্থানেই পাইল ক্যাপ রি-ডিজাইন করতে হচ্ছে।

সেভ দ্য রোড আরো জানায়, প্রকল্পের ১ নম্বর প্যাকেজের আওতায় ১৬ কিলোমিটার বিআরটি লেন ও ১৯টি স্টেশনসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছে অন্য একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি)। গত জুনে এই প্যাকেজের নির্মাণকাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৪২ দশমিক ৫২ শতাংশ কাজ এগিয়েছে।

জানা গেছে, ২০১২ সালে শুরু হওয়া বিআরটি প্রকল্পের কাজ ১০ বছর ধরে চলছে। কবে শেষ হবে সেই বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App