×

মুক্তচিন্তা

৩টি গোপন নৈশভোজ ও ১টি জাতিকে বিলীনের চক্রান্ত

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২, ১২:১৪ এএম

৩টি গোপন নৈশভোজ ও ১টি জাতিকে বিলীনের চক্রান্ত
জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সামষ্টিকভাবে জাতি ও জাতিসত্তাকে বিলীন করার চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল ১৫ আগস্টের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ পরাজয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতির পরাজয় দেশ দুটিকে প্রচণ্ড প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। তারা বাংলাদেশের জাতিতাত্ত্বিক অস্তিত্ব বিলীন করে ভাবাদর্শে শ্যাডো-পাকিস্তান রূপায়ণের নতুন পরিকল্পনা করে। স্বাধীন বাঙালি জাতিকে পুনরায় আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি করতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত করে। হত্যাকাণ্ডের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয় হেনরি কিসিঞ্জার, জুলফিকার আলী ভুট্টো, সিএইএ, আইএসআইর যৌথ ষড়যন্ত্রে। আর ফিল্ড-মিশন বাস্তবায়ন করে এদেশের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকরা। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চক্রের এটিই ফার্স্ট এন্ড ফাইনাল মিশন ছিল না। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত স্বপন দেব রচিত ‘বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গবেষকের ভাষায়, ‘১৫ আগস্ট যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হলো সেটি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রথম চেষ্টা ছিল না। এর আগে আরো ২২ বার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত হয়েছিল। ১৯৫৫-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই ২০ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ২৩ বার হত্যার চক্রান্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল ২৩তম হত্যাচেষ্টা, যে বার চক্রান্তকারীরা সফল হয়েছিল।’ ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্স ২০০১ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘ঞযব ঞৎরধষ ড়ভ ঐবহৎু করংংরহমবৎ’-এ বলিষ্ঠভাবে লিখেছেন, ‘করংংরহমবৎ ধিং ৎবংঢ়ড়হংরনষব ভড়ৎ শরষষরহম ড়ভ ঃযড়ঁংধহফং ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব, রহপষঁফরহম ঝযবরশয গঁলরনড়ৎ (গঁলরনঁৎ) জধযসধহ’। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সিএইএর ভূমিকা সম্পর্কে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনি ১৯৭৭ সালের নির্বাচনী প্রচারণাসভায় বলেছিলেন, ‘চিলি ও বাংলাদেশে সিআইএ যে ধরনের গোপন অপারেশন চালিয়েছে ক্ষমতায় এলে তিনি তা বন্ধ করবেন।’ ষড়যন্ত্রের আরেকটি স্পষ্ট সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে দেয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভাষণের মধ্যে। জুন, ১৯৭৫ সালের সেই অনুষ্ঠানে ভুট্টো বাংলাদেশকে ইঙ্গিত করে বলে, ‘এই অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ খুব আস্থার সাথে ভুট্টোর এমন বক্তব্য দেয়ার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন সিআইএর স্টেশন প্রধান ফিলিপ চেরি। সিএইএর এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় ফিল্ড-অর্গানাইজারের ভূমিকায় ছিল। সে হেনরি কিসিঞ্জার ও ভুট্টোর পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিল্ড-একশন বাস্তবায়ন করত। খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে গোয়েন্দা চেরি মেজর ডালিম, ফারুক, রশীদদের সংগঠিত এবং কিলিং-মিশনের জন্য প্রস্তুত করত। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎসের ‘বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে ফিলিপ চেরির স্বীকারোক্তিমূলক সাক্ষাৎকার রয়েছে। তবে জিয়াউর রহমান আরো এক ধাপ এগিয়ে ষড়যন্ত্রের অংশীজন হিসেবে পেন্টাগনের আস্থা অর্জন করে এবং ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাসের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ গড়ে তোলে। জিয়াউর রহমানের এ ধরনের তৎপরতার বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির হাতে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছিল এবং তিনি সেসব ভারত সরকারকে সরবরাহ করেছিলেন। এছাড়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক হ্যারল্ড স্যান্ডার্স, মার্কিন কনসাল জেনারেল হাবর্টি গর্ডন, জর্জ গ্রিফিন গং খন্দকার মোশতাককে ঘিরে তাদের নীল-নকশা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তৈরি করে। মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান গং সিআইএর আজ্ঞাবহ গুপ্তচর হিসেবে পুরো কিলিং মিশনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও সরকার পরিবর্তনের প্রাইম-মিশন দিয়ে ১৯৭৪ সালে ডেভিড ইউজিন বোস্টারকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করে। ডেভিড ইউজিন বোস্টার ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের অনুগত ও বিশ্বস্ত। সে বাংলাদেশে এসেই তার পূর্ব পরিচিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শুরু করে। বিশেষ করে খন্দকার মোশতাক ডেভিড বোস্টারের রাডারেই ছিল। আর জিয়াউর রহমানের সাথে তার নতুন তবে প্রগাঢ় সখ্য গড়ে ওঠে। মাঝে মধ্যেই তারা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে সাক্ষাৎ করত। ঘটনাটি ৮ আগস্ট, ১৯৭৫-এর। ইউজিন বোস্টার ও খন্দকার মোশতাক ঢাকায় এক গোপন নৈশভোজে সাক্ষাৎ করে। বৈঠকে রাষ্ট্রদূত বোস্টার মোশতাকের মাইন্ড রিড করার এবং কিলিং-মিশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। খন্দকার মোশতাকও আমেরিকার আনুকূল্য ও আশ্রয় পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা কটূক্তি এবং তার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ধারাবাহিক মিথ্যাচার করতে থাকে। বোস্টার-মোশতাকের প্রথম নৈশভোজের পর দ্বিতীয় নৈশভোজে মিলিত হয় জিয়াউর রহমান ও ফিলিপ চেরি। বৈঠকগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও সরকার পরিবর্তনের চক্রান্ত ও পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। জিয়া-চেরির বৈঠক ও সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো ডালিম, ফারুক, রশীদদের নির্দেশনা আকারে জানিয়ে দেয়া হয়। জানিয়ে দেয় মেজর জেনারেল জিয়া। জিয়াউর রহমান ছিল মূলত মেজর ডালিম, ফারুক, রশীদদের মেন্টর। তার নির্দেশনা অনুযায়ী ১২ আগস্ট ফারুক ও রশিদ তৃতীয় নৈশভোজে মিলিত হয়। সেখানে নির্মম হত্যাযজ্ঞের এক্সিকিউশান প্ল্যান রিভিউ করা হয়। পনেরোই আগস্টের প্রাক্কালে এই তিনটি নৈশভোজ ছিল বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি সদ্যস্বাধীন জাতিকে বিলীন করার ভয়াবহ চক্রান্তক্ষণ। অতঃপর ১৫ আগস্ট ভোরে কোটি বাঙালির হৃদয় বিদীর্ণ করে জাতির পিতাকে কাপুরুষের মতো ছিনিয়ে নিলো ইতিহাসের বর্বরতম হন্তারকরা। এ হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড সকল নৃশংসতাকে হার মানায়, এ হত্যাকাণ্ড সব পাশবিকতাকে হার মানায়। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর মধ্য দিয়ে সেদিন মুখ থুবড়ে পড়েছিল পুরো জাতি ও রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের আদলে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা দেয় খন্দকার মোশতাক। পাকিস্তানের অনুকরণে ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুছে ফেলা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। এছাড়া জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয়। তার নির্দেশে ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিবর্তন করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রচলন হয়। সে ১৯৭৮ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের শাশ্বত-স্মারক, বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক জাতীয় পতাকাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে। এমনকি ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল খন্দকার মোশতাকের জারিকৃত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ১৯৭৫’-কে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে পঞ্চম সংশোধনী আইন পাস করে ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তি দেয় এবং বিদেশে তাদের বিভিন্ন উচ্চপদে নিযুক্ত করে। পৃথিবীতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বা রাষ্ট্রপ্রধান হত্যার নির্মম ইতিহাস অনেক আছে। রাজা প্রথম চার্লস, প্যাট্রিস লুমুম্বা, নগুয়েন দিন দিয়েম, সালভাদর আলেন্দে, আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড সারা পৃথিবীকে মর্মাহত করেছে। তবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার চক্রান্ত ও উদ্দেশ্য সব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মোটিভ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও সুগভীর। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন বিশ্ব তথা আঞ্চলিক রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটত। সাম্য ও উদারতা প্রতিষ্ঠিত হতো। বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষিত হতো। এ বিষয়গুলোও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিকূল স্টেক হোল্ডারদের দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। শেখ ফয়সল আমীন : কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App