×

জাতীয়

পরিবেশ বিপর্যয়ে সৈকতে ভাঙন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২২, ০৮:৩১ এএম

পরিবেশ বিপর্যয়ে সৈকতে ভাঙন

ছবি: ভোরের কাগজ

অস্বাভাবিক জোয়ারে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দেয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে এর চিরচেনা সৌন্দর্য। সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলী ও ডায়াবেটিক পয়েন্ট, কবিতা চত্বর এবং বালিয়াড়ি সৈকতে চলমান তীব্র ভাঙন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ফলে কক্সবাজারের পর্যটন খাত নিয়েও দেখা দিয়েছে নতুন শঙ্কা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে ভাঙন। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এটা হচ্ছে, যা জোয়ারের কারণে বড় আকার ধারণ করেছে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিশেষ করে সাগরের স্বাভাবিক গতিকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করাই বর্তমানে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) নিষেধাজ্ঞাগুলো না মানা, সৈকতের ঝাউবন উজাড় করা, সাগর লতার অভাব, যেখানে জিওব্যাগ দেয়া হচ্ছে সেখান থেকেই বালু উত্তোলন, সৈকতের বালুর উপরে বহুতল ভবন নির্মাণ, পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি যথাযথ বিবেচনা না করে উপকূলে উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন, সমুদ্রের নিচে পানির স্রোতের পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ই সমুদ্রসৈকতের বড় ভাঙনের কারণ। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে দেশের সব উপকূল এলাকাতেই বড় আকারের ভাঙন শুরু হতে পারে। এমনকি কক্সবাজার এক সময় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বীচের মতো হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ৩ বছর আগে থেকেই ভাঙন শুরু হয়েছে। জোয়ারের কারণে এটি তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর পেছনে পরিবেশ বিপর্যয়ই মূলত দায়ী। কারণ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করার পর যে নিষেধাজ্ঞা পালন করা উচিত ছিল, সেগুলো করা হয়নি। উল্টো ঝাউবন উজাড় করা হয়েছে, সাগর লতার প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে। সৈকতের ৩০০ মিটারের মধ্যে ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ না করতে আদালত ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) আদেশ অমান্য করা হয়েছে।

গত এক দশকে সৈকতের বালুর উপরে নির্মাণ করা হয়েছে একের পর এক বহুতল ভবন। বসানো হয়েছে বিপণিবিতান। ভাঙন ঠেকাতে যে জিওব্যাগ দেয়া হচ্ছে, সেগুলোর বালু ওই জায়গা থেকেই তোলা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ভাঙন। এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, আপাত দৃষ্টিতে জোয়ারের কারণে ভাঙন মনে হলেও, বাস্তবতা হচ্ছে প্রকৃতি কঠিন প্রতিশোধ নিচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সমুদ্রসৈকতে ওয়াকওয়ে নির্মাণের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকেও সরে আসতে হবে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দ্বীপু জানিয়েছেন, সমুদ্রের স্বাভাবিক গতি ঠেকানোর চেষ্টা করায় ভাঙন তীব্র হয়েছে। কক্সবাজারে ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত আছে। শুধু ৩ কিলোমিটার এলাকায় এই ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে শুধু জিওব্যাগ দিয়ে সমুদ্রকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যার কারণে এসব এলাকায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সমুদ্রের ঢেউ স্বাভাবিক গতিতে আসবে এবং স্বাভাবিক গতিতে নেমে যাবে এটাই নিয়ম। এটি রুখতে গেলেই এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে সমুদ্র।

সামাজিক সংগঠন ‘ইয়েস কক্সবাজারের’ প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত বাঁধ ভাঙনের অন্যতম কারণ। এই বাঁধের কারণেই সমুদ্র তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পর্যটন ও পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ভোরের কাগজকে বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে আগেও কম-বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে এখনকার ভাঙন বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ হতে পারে সমুদ্রের তলদেশের পানির স্রোতের গতি পরিবর্তন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়াও আরেকটি কারণ। এই দুই কারণে পানি বেশি উত্তাল হচ্ছে। যার ফলাফল বড় ভাঙন দেখা দেয়া। পবা চেয়ারম্যান আরো বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় কক্সবাজার ছাড়াও ভাঙন দেখা দিচ্ছে কুয়াকাটা, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায়।

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল ভোরের কাগজকে বলেন, পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে পরিমাপ না করে উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উপকূলের বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। এটিও ভাঙনের অন্যতম একটি কারণ। এভাবে চলতে থাকলে ভাঙন আরো বাড়বে।

কক্সবাজার চেম্বার অ্যান্ড কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, যেখানে জিওব্যাগ আছে সেখানে না ভেঙে এখন নতুন নতুন এলাকা ভাঙতে শুরু করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজার পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় লাবনী পয়েন্টের পুলিশ বক্স পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে। ডায়াবেটিস পয়েন্টের অনেকাংশে ঝাউবাগান ধসে পড়েছে। পাকা দেয়াল পর্যন্ত ভেঙে গেছে। এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে ভাঙনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। না হয় ধীরে ধীরে কক্সবাজার সৈকতের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সৈকতে বিশাল আকৃতির ঢেউ সৈকতে আছড়ে পড়ছে। গত কয়েকদিনে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের ১০টি পয়েন্টে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে সৈকতের ছাতা ও ঝিনুক মার্কেটও। গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ভাঙনের সৃষ্টি হওয়ায় সৈকতে বেড়াতে যাওয়া পর্যটক এবং স্থানীয়দের মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় গত শুক্রবার দুপুরে ভাঙন পরিস্থিতি দেখতে যান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার।

পরিদর্শন শেষে সিনিয়র সচিব বলেন, ভাঙনরোধে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে অস্থায়ীভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছি। এখানে অনেক উঁচু বাঁধ দরকার। ইতোমধ্যে আমরা একনেকে তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প জমা দিয়েছি। নাজিরারটেক থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ হবে। তখন হয়তো সাগরের ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে কক্সবাজার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App