×

মুক্তচিন্তা

আগামীকাল ১৫ আগস্ট : বাঙালির স্তব্ধ শোকের দিন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২২, ০১:৪০ এএম

আগামীকাল ১৫ আগস্ট- বাঙালির শোকস্তব্ধ ১৫ আগস্ট! ১৯৭৫ সালের এই দিনটিতে আমরা হারাই আমাদের প্রাণের নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৪ আগস্ট রাত তথা ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে হায়েনা ঘাতকের বুলেটে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা- সঙ্গে তাঁর প্রিয় পরিবারের ১৮ সদস্য! ১৫ আগস্ট তাই আমাদের স্তব্ধ শোকের দিন- আগস্ট বাঙালির শোকের মাতমের মাস। বাঙালির করুণার্দ্র শোকগাথার দুঃসহ মাসের নাম আগস্ট। ১৫ আগস্টের শোকে আমরা মূহ্যমান। বেদনার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বারবার আগস্ট আসে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বাংলাদেশের সমগ্র মানচিত্রজুড়ে! হৃদয় প্লাবিত করে শোকের বন্যা বয়ে যায়। এ মাসে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি বলে এর প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণ শোকের আবহে করুণ সুরে বেজে চলে হৃদয়ের গভীরে। বাঙালির শোকের অশ্রæতে অবিরল ভিজতে থাকে ক্যালেন্ডারের পাতা- নীরবে-নিভৃতে ভিজে যায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন স্বদেশ। ৩২ নম্বর থেকে বয়ে-চলা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর জ্ঞাতি-স্বজনের রক্তধারা আগস্টের ১৫ তারিখে এই ভূগোল-বাংলাকে নিমজ্জিত করে দেয় ঘোর এক বেদনার অতলে। বাংলার মাটি ও বাংলার জল বঙ্গবন্ধুর রক্তে কী বেদনার আবহে রঞ্জিত ভাবতেই আগস্টের আকাশ-বাতাসও নিঃসীম শোকের ঘন নীল-নীলাভ্রের হাহাকারে আমাদের সঙ্গে কেঁদে কেঁদে ওঠে! শ্রাবণের ঘন নীল গভীর নিকষ রাত্রির ভোরে নির্মম ঘাতকের বুলেটের শব্দে তন্দ্রা ভাঙলে দেখি আমরা স্বজনহারা, আমরা পিতৃহীন- জাতি পিতৃহীন! কোন ‘গোকূলে’র ষড়যন্ত্রে বধ হলেন পিতা, কেন বধ হলেন? কারা সেই নির্মম ঘাতক, কুটিল ষড়যন্ত্রী? ‘পিতৃহত্যা মহাপাপ’ জেনেও ইতিহাস কলঙ্কিত করে কোন অকৃতজ্ঞ সন্তান! আমরা হারিয়ে ফেলি পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির স্বপ্নবাজ মহাপুরুষ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতাকে। হায় অকৃতজ্ঞ নরপিশাচের দল, তোদের ধিক্কার দেব সে ভাষা কই? এদেশের অসহায় ও নিরন্ন মানুষের ভাগ্যে ‘দুবেলা দুমুঠো ভাত ও মোটা কাপড়ের অধিকার’ নিশ্চিত করার স্বপ্ন নিয়ে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন নিয়ে শৈশব থেকে যিনি সোচ্চার ছিলেন, যৌবনে যিনি শাসকের রক্তচক্ষুর বিষাক্ত ছোবলের উপর্যুপরি শিকার হয়েছেন, যিনি এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ‘অপরাধে’ কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও দীর্ঘতম সময়, যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অনিশ্চিত বন্দি জীবনযাপন করেছেন পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে, স্বাধীন দেশে যার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পজগতের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবে রূপদানের কর্মকাণ্ড, বাঙালির এমন এক ভূমিপুত্র, বাঙালির এমন এক পরিত্রাণকর্তা, বাঙালির এমন এক ধন্য পুরুষকেই ঘাতকরা শ্রাবণ-রাত্রির ঘনঘোর অন্ধকারে হত্যা করেছে, হায়! হত্যা করেছে ৭ বছরের শিশু রাসেলসহ পরিবারের ১৮ সদস্য। সেই ধন্য পুরুষের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর ঐশ্বর্যশালী হৃদয়ের অবয়ব কবির চিত্তকে দোলায়িত করে মুহুর্মুহু- অথচ উন্মত্ত ঘাতকরা তাকেই হত্যা করে। কবি লিখেন : ‘ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল/ গান হয়ে/ নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যাঁর নামের ওপর/ কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া/ ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস/ ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো/ দুলতে থাকে স্বাধীনতা/ ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’ [শামসুর রাহমান] পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো নিদারুণ ঘটনা বিশ্বে বিরল। সমগ্র বিশ্ব সেদিন এ হত্যাকাণ্ডে হতবাক ও বিস্মিত হয়েছিল! নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন : ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’ ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ হত্যাকারীদের জঘন্য কর্মকাণ্ডকে আরো স্পষ্ট করে। জাতি আজো সেসব কুকীর্তির দায় বহন করছে। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন : ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন : ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম-কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন : ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ এ রকম আরো কত বরেণ্য ব্যক্তিত্বের কত স্মরণীয় মন্তব্য! প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে বলেছেন : ‘শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উঁচুতে ছিল তাঁর মাথাটি, সহজেই চোখে পড়ত তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তাঁর পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সব বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ। জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়, হিটলার-মুসোলিনির মতো একনায়করাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করেছিল, যার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিল। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলেন শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।’ ঘাতকরা সব শুভকে পণ্ড করেছে এই মহাপুরুষটিকে হত্যার মাধ্যমে! হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করলেও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সম্মানের-সমীহের সঙ্গে বলেছিলেন : ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী ২০ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যবে না।’ বঙ্গবন্ধু হত্যারই তো ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে- কিন্তু কিসিঞ্জার-কথিত কেবল এশিয়া কেন সমগ্র বিশ্ব কী মুজিবের মতো একজন নেতার জন্ম দিতে পেরেছে? পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। মুজিব ক্ষণজন্মা এক বিশ্বনেতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিবিসি মন্তব্য করেছিল : ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছিল।’ তাই উইলিবান্টের মন্তব্য ঘাতকদের উদ্দেশ্যে অবচেতনে আমরাও স্মরণ করি সব সময়। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে দিশাহারা জাতি, দিশাহারা মানুষ। দিশাহারা এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর, কেরানি, শিক্ষার্থী থেকে কবি সবাই। ১৫ আগস্ট সকালে খুনি মোশতাকের বেতার ভাষণে শোকে মূহ্যমান জাতির পক্ষ থেকে কোথাও কোথাও মৃদু প্রতিবাদ হলেও সশস্ত্র ত্রাসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ ঘটেনি! কিন্তু বাঙালির মনের গভীরে- বাঙালি বাউল, শিল্পী, কামার, কুমোর, কবির হৃদয় নিঃসঙ্গ বেদনার চাপা-কান্নায় নিনাদিত হয়েছে। করুণ সুরে আর্তনাদ করেছে এদেশের মাটি, জল, জঙ্গল, বৃক্ষ লতাপাতা। মানুষের চিত্তভূমি তারই হতশ্বাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে এইরূপে : ‘তোমাকে হারিয়ে/ আমরা সন্ধ্যায়, হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো হয়ে যাচ্ছিলাম/ আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে/ তোমার বিচ্ছেদের সংকটের দিনে/ আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপ ক্রন্দনে/ আকাশকে ব্যথিত করে তুললাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে/ রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেননা জেনেছি-/ জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।’ [শামসুর রাহমান] ঘাতক পিশাচরা বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারের কোনো চিহ্ন রাখতে চায়নি এই ভূগোল-বাংলায়। তাকে সবংশ নিধনে পৈশাচিক উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে কোমর বেঁধে নেমেছিল নরঘাতকের দল- ক্ষমতা লোভীর দল, সাগরসম রক্ত ঝরাতে নেমে এসেছিল রাত্রির অন্ধকারে বাঙালির আশ্রয়, বাঙালির হৃদয় ৩২ নম্বরে! মুজিব-আদর্শের চিহ্ন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলে এমন সাধ্য কার? ঘাতক ও নরপিশাচদের সাধ্য থাকে না- থাকে না নৈতিক জোর! তাই বিশ্বাস-ঘাতকরাই আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত! আর কালান্তরে বঙ্গবন্ধু উজ্জ¦ল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন কর্ম ও আদর্শগুণে। ব্রায়ান বারন ১৯৭৫ সালেই এরূপ ইঙ্গিত করে বলেছিলেন : ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেটবিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’ আজকের বাস্তবতায় তার কথা প্রমাণিত। ঘাতকরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত বটে কিন্তু এখনো সক্রিয় তারা, এখনো সহসা ষড়যন্ত্রের ফণা তুলে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব রক্তধারা ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার সাধ ঘাতকদের মিটেনি! ৪৭ বছরেও মিটেনি ঘাতকের রক্ত-পিপাসা! বিদেশে অবস্থানের জন্য ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা পেয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করছে অন্ধকারের সেই পশুশক্তি। কিন্তু বাঙালির ভালোবাসা, জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর দেশবাসীর আস্থা আর মহান সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপা তাকে বারবারই ঘাতকের লেলিহান ছোবল থেকে রক্ষা করে চলেছে। শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যা চেষ্টাকারীরা নতুন কোনো গ্রহের নতুন কোনো শক্তি নয়- সেই পুরনো ঘাতকেরই উত্তর-প্রজন্মমাত্র! বাঙালির ভাগ্যোন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সমুন্নত রেখে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞা ও দৃঢ় নেতৃত্বে স্বাধীন স্বদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করছেন বলেই ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির উত্তর-প্রজন্ম এখনো তার ওপরই খড়গহস্ত! আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App