×

মুক্তচিন্তা

‘মানিয়ে নাও’- আর কতদিন নারী শুনবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২২, ১২:৪৬ এএম

বাংলাদেশের উত্তর জনপদ জেলা নাটোর। অভিযুক্ত চাঁন মুহম্মদ এক তরুণীর গলা ও হাত কামড়ে জখম করে দেয়। নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী জানান, দুবছর আগে তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। অনেক আগে থেকেই চাঁন তাকে কুপ্রস্তাব দিচ্ছিল। ওই রাতে তরুণী ঘরের বাইরে বের হলে চাঁন তাকে জাপটে ধরে ধর্ষণের চেষ্টা করে। বাধা দিলে গলা ও হাত কামড়ে জখম করে। কোনো উপায় না পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে হাতের কাছে থাকা ছুরি দিয়ে তরুণী চাঁনের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেন। অন্যদিকে নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে চলন্ত বাস থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বদিরহাটের এক পোশাক কর্মী। খালি বাস পেয়ে বাসের চালক-হেলপার তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিল। নিজেকে বাঁচাতে চলন্ত বাস থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন তরুণী। তবে এক সপ্তাহ পর হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে আসে তরুণীটির এবং প্রাণে বেঁচে যান। ২০১৯ সালে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। তবে এসব তো ঘরের বাইরে অপেক্ষা করা নারীর জন্য নৃশংসতার ফাঁদ। কিন্তু সেই নারী কি গৃহেও নির্ভয়ে আছে? ভারতের রেণু খাতুনের বাম হাত কেটে দিয়েছে তারই বৈবাহিক সঙ্গী। সরিফুল রেণুকে চাকরি করতে দিতে চায়নি। একচ্ছত্র মালিকানা হারানোর ভয় ছিল হয়তো। স্বামী একদিন সুপারি দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হাত কেটে নিল রেণুর। ২৮ বছরের মেয়েটার নাম মার্গারিটা গ্রাচেভা। গার্হস্থ্য হিংসা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে রাশিয়ার একটি টিভি চ্যানেলের বিশেষ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন মার্গারিটা। মার্গারিটা ওই দায়িত্ব বেছে নেন, কারণ তিনি নিজে ছিলেন নারকীয় গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। তার দুটি হাত কুপিয়ে কেটে নিয়েছিল তার প্রাক্তন স্বামী। বাম হাতটা জোড়া দেয়া গেলেও ডান হাতটা চিরতরে হারান মার্গারিটা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। মার্গারিটার স্বামী তাকে গাড়িতে চাপিয়ে টেনে নিয়ে যায় সেন্ট পিটার্সবার্গের বাড়ি থেকে বেশ দূরে একটা বনের মধ্যে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কুড়াল নিয়ে। কুড়ালের ৪০টি কোপের আঘাত বহন করেছিল মার্গারেটের শরীর। ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দু’ট হাত। বরফের ওপর পড়েছিল বলে একটি হাত পরে তুলে নিয়ে জোড়া দেয়া সম্ভব হয়। ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকলে পাতার পর পাতা ভরে যাবে একই রকমের গৃহহিংসার ঘটনা। গৃহহিংসা সব সমাজে ঘটছে, সব দেশে ঘটছে, সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটছে। জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ সংক্রান্ত দপ্তর ২০১৮ সালে জানিয়েছিল, বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ জন নারী পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হন। কোনো কোনো দেশে ঘর নারীর জন্য বাইরের থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ। আজো গৃহহিংসা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা এড়াতে একে ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক বিষয় বলে উড়িয়ে দেয়া হয়। কখনো শাসনকে সোহাগের সহচর ভাবা হয়। বিবাহের পবিত্র বন্ধন যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখার পরামর্শ মেয়েরা নিজের পরিবার থেকেই লাভ করে সবার আগে। এমন নির্যাতকরা বহিঃশত্রæ নয়, ভালোবাসার মানুষ। ভিকটিম অনেক সময়ই বুঝে উঠতে পারে না, ব্যক্তির কোন সত্তাটি সত্যি- নির্যাতকের না প্রেমিকার! এমন ভাবনার হাত ধরেই হানিমুন ফেজ, টেনশন ফেজ, ভায়োলেন্স ফেজের নিরন্তর চক্র চলতে থাকে। এই কুণ্ডুলী ভিকটিমকে ঘূর্ণের মতো সমুদ্রের তলদেশে টেনে নিয়ে আছড়ে মারছে প্রতিনিয়ত। সমাজ-পরিবার কিন্তু স্বামী-প্রেমিককে বারবার সুযোগ দেয়ার পক্ষে। তাই অনেক সময়ই ভিকটিম এই কুণ্ডুলী ভেদ করে বেরোতে পারেন না। অগত্যা মৃত্যু, আত্মহত্যা বা অঙ্গহানির অপেক্ষা। বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ কিনা- এই বিতর্কে ভারতের দিল্লি হাইকোর্ট দ্বিখণ্ডিত রায় দিয়েছে ইদানীংকালে। বিচারপতি হরি শংকর দণ্ডবিধির ছাড়টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে অসম্মত হয়েছেন। কারণ তার মতে, দণ্ডবিধিতে এ ছাড়টি রাখা হয়েছে ‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠানটির গায়ে যাতে ধর্ষণের অভিযোগের কলঙ্ক না লাগে। অন্যদিকে বিচারপতি রাজীব শকধেরের মতে, বৈবাহিক সম্পর্কেও ধর্ষণ হলে তা ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। তাহলে তা হবে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। ১৮৯১ সালে অবিভক্ত ভারতে ফুলমনি নামে ১১ বছর বয়সি এক বালিকার সঙ্গে তার স্বামী হরিমোহন মাইতি বলপূর্বক যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হলে যৌনাঙ্গে চোট ও প্রবল রক্তক্ষরণে ফুলমনির মৃত্যু ঘটেছিল। ঘটনাটি নিয়ে সে সময় প্রবল হইচই হয়েছিল। তার ফলে পরিবর্তন এসেছিল- বিবাহিত জীবনে যৌনতায় সম্মতি জানানোর বয়স ১০ থেকে বাড়িয়ে তখন ১২ করা হয়েছিল। সংবিধানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মৌলিক অধিকার স্বীকৃত। এ ধারাটি মানুষের জীবনে তার আত্মমর্যাদা, স্বনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও শরীরের ওপর অধিকারের গুরুত্ব শিকার করে। ধর্ষণ যার হাতেই ঘটুক না কেন, তাতে এই তিনটি মৌলিক অধিকারের প্রত্যেকটিই ক্ষুণ্ন হয়। বিবাহিত স্ত্রী তার নিজের ওপর অধিকার রশিটি স্বামীর হাতে সমর্পণ করার ধারণাটি সংবিধানের চরিত্রবিরোধী। প্রসবের পরে মায়ের কাছে গিয়ে সন্তানকে দেখিয়ে বলা হয়, আপনার সন্তান দেখুন। ঠিক তারপরই জানতে চাওয়া হয়, দেখে বলুন কী বাচ্চা হয়েছে? মা-ই ঘোষণা করেন সন্তান মেয়ে নাকি ছেলে। সারা পৃথিবীতেই এটিই মান্য প্রক্রিয়া। ব্যাস, এটুকুই শুধু তার অধিকার। তারপর আর কোনো অধিকার যেন তার হাতে নেই। বাবার বাড়ি তার নিজের নয়, শ্বশুর বাড়িও তার নিজের নয়। সারাজীবন সে খুঁজতে থাকে- কে বা কারা নিজের, নিজের বলতে কোন খানাটুকু? আজ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও ভারত, বাংলাদেশে নারী নিরাপত্তার কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছতে পারেনি দেশ। আজো সাম্যের কথা আলোচনা হয়েই চলে। চাকরির ক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, বেতনের ক্ষেত্রে সেই সাম্য চোখে পড়ে না। আজো রাতে পথচলায় নারী সুরক্ষিত নয়। এখনো তাকে শুনতে হয়, একটু সাবধানে পথে-ঘাটে চলিস- যতই হোক মেয়ে তো! সমাজ, পরিবার, প্রশাসন এদের কাছ থেকে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি শোনে- ‘মানিয়ে নাও’। হ্যাঁ, এ দেশের মেয়েরা সব থেকে ভালো এই কাজটি করতে পারেন। ঘরে-বাইরে, সব অন্যায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস তাদের যেন জন্মগত। গৃহহিংসার ক্ষেত্রেও এই সামাজিক রীতি একইভাবে চেপে বসে আছে। সমাজ বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে- গৃহহিংসা অর্জিত আচরণ। পিতৃতান্ত্রিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ দেখে শেখা- এই অর্জন ত্বরান্বিত হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। নির্যাতন সেখানে নিঃশর্ত বশ্যতা চায়, চায় তর্ক-বিবাদ-বিরোধহীন ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ। পেশা নির্বাচন ও বিবাহিত সম্পর্কটির মাঝপথে চাকরির শর্ত হয়ে দাঁড়ায় ‘বাড়ি-সন্তান সামলিয়ে যদি করতে পার…।’ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দূরে থাক, সামান্য অসম্মতিও হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক অশান্তির কারণ। পরিবর্তন প্রয়োজন- এমন বিশ্বাস আজ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা অনেক গৃহবাসীকেই স্পর্শ করতে পারছে না। তবে একটু একটু দোলা দিচ্ছে বুঝি নতুন বাতাস। লাগুক সময়, লাগুক অনেক ত্যাগ- একদিন যদি তারা সংখ্যায় বেড়ে যায়। কিশোরগঞ্জ আন্তঃনগর এগারসিন্দুর ট্রেন থেকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে এসে নামলেন দলটি। ১৫ জন তরুণীর পরনে ছিল টাইট জিন্স ও টি-শার্ট। ১৭ জন তরুণী ও ৩ জন তরুণ প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এ সফরে আসেন। এ নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনেই একজন তরুণী পোশাকের কারণে হেনস্তার স্বীকার হয়েছিলেন। এ সময় মধ্যবয়সি এক নারী ওই তরুণীকে বলেন, এটা কী পোশাক পরেছ তুমি? তরুণীর পাল্টা প্রশ্ন- তাতে আপনার সমস্যা কী? ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে ঘিরে বসেছে একদল ব্যক্তি। একপর্যায়ে ওই তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে উদ্ধত হলে বয়স্ক এক নারী তাকে ধরে ফেলেন। অশ্লীল গালিগালাজ করেন, তার পোশাক ধরে টানাটানি করেন। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন তরুণী। এ ঘটনার প্রতিবাদে একদল তরুণ-তরুণী কিশোরগঞ্জগামী এগারসিন্দুর ট্রেন থেকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে এসে নামে। অংশগ্রহণকারীরা অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের নারীবাদী গ্রাসরুটস অরগানাইজিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত। একটি স্টোরিটেলিং প্রকল্প হিসেবে তারা পিতৃতন্ত্রে নারীর আগুনে মোড়ানো পথের গল্পগুলো তুলে আনেন। ঢাকা-নরসিংদী যাত্রা এরই একটা অংশ। এদের মধ্যে কেউ নারীবাদী, শিল্পী, সংগঠক, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আলোকচিত্রী, গবেষক, উন্নয়নকর্মী এবং কেউ প্রকৌশলী। অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারান খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, আমরা নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন ও এখানকার মানুষদের দেখতে এসেছি। তাদের সঙ্গে আমরা মানবিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য, শান্তিপূর্ণভাবে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গা রিক্লেইম করা। প্রতিবাদটি যেন একটু অন্য কথা বলছে। যেখানে প্রশাসন, সমাজ আর পরিবারের তরফে যে কথাটি এই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি শোনেন, তা হলো- ‘মানিয়ে নাও’। হ্যাঁ, এ দেশের মেয়েরা সব থেকে ভালো এ কাজটি করতে পারেন। ঘরে-বাইরে, উভয় ক্ষেত্রে। সব অন্যায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস তাদের যেন জন্মগত। নরসিংদীর এই প্রতিবাদ যেন নতুন উপলব্ধির স্থান করে দিচ্ছে। ‘মানিয়ে নাও’- এমন স্লোগান বুঝি প্রতিবাদের ধাক্কা খাওয়ার একটু হলেও নতুন পথ দেখার সুযোগ পাচ্ছে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App