×

জাতীয়

চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২২, ০৮:০৮ এএম

চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন

ছবি: সংগৃহীত

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গায়েগতরে খেটে পান মাত্র ১২০ টাকা। সেই মজুরির টাকা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করতে চান তারা। কিন্তু যারা ৩০০ টাকা করে দেবেন সেই মালিকপক্ষ তাতে সাড়া দিচ্ছেন না। এর ফলে গত চার দিন ধরে দেশের ৫টি জেলায় ২৪১টি চা বাগানে কয়েক ঘণ্টা করে চলছে ধর্মঘট। আজ শনিবার থেকে পুরো ধর্মঘটে যাচ্ছেন তারা।

হবিগঞ্জের আমু চা বাগানের শ্রমিক মিনতি সন্তুবায় বলেন, আমরা সারাদিন চা বাগানে কাজ করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পাই, যা দিয়ে ২ কেজি চালও কিনতে পারি না। এক লিটার তেলের দাম ২০০ টাকা। ছেলেমেয়ে সাধ-আহ্লাদও পূরণ করতে পারি না। মা-বাবা হয়ে যদি ছেলেমেয়ের সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে না পারি তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কী? এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।

বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, দেশে সব জিনিসের দাম হু-হু করে বাড়ছে। অথচ চা শ্রমিকরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করে ১২০ টাকা মজুরি পান। দুই কেজি সবজি কিনতেই এই টাকা চলে যায়। তাই শ্রমিকদের বাঁচানোর স্বার্থে মজুরি ৩০০ টাকা করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু মালিকপক্ষ কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। চান্দপুর বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সাধন সাওতাল বলেন, চা শ্রমিকরা দেশের ভোটার হয়েও অবহেলিত। মৌলিক অধিকারও তাদের ভাগ্যে জোটে না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দিনে মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। এভাবে আমরা চলতে পারছি না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে বাগান বন্ধ করে দিয়েছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাগানে ফিরব না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এক সময় চা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ পয়সার প্রচলন ছিল। চা শ্রমিকদের হাজরি (মজুরি) হিসাবে দেয়া হতো এই পয়সা, যা বাগানের বাহিরে চলত না। এর উদ্দেশ্য ছিল তারা যাতে বাহিরে যেতে না পারে। এজন্য তখন থেকেই চালু করা হয় রেশনিং ব্যবস্থা। কালক্রমে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বিশেষ পয়সার পরিবর্তে হাজরি হিসাবে টাকা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রাক্তন সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জী জানান, চা শ্রমিকদের শুরুর দিকে মাসিক বেতন ছিল ৫ টাকা। এই টাকা আবার বাইরে চলত না। ব্রিটিশরা শ্রমিকদের পেটেও মারত, পিঠেও মারত। অবর্ণনীয় নির্যাতন ও দুর্ভোগ পোহাতে হয় শ্রমিকদের। বলা চলে এটি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। পরবর্তী সময়ে এই বিশেষ টাকার পরিবর্তে মূল টাকা দেয়া হয়। তিনি জানান, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর নারী চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি/হাজরি ছিল এক টাকা এক আনা ও পুরুষদের ছিল এক টাকা দুই আনা। পরবর্তী সময়ে তা ক্রমশ বেড়ে বিভিন্ন সময়ে দৈনিক হাজরি হয় ৮ টাকা, ১২ টাকা, ১৮ টাকা, ২০ টাকা, ২২ টাকা ও ২৪ টাকা। ২০০৮ সালে হয় ৩২ টাকা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৭ সালে ১০২ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ টাকায়। তবে ‘বি’ ক্লাস ও ‘সি’ ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের বেতন আরো কম। এর সঙ্গে কাজের উপস্থিতিতে বোনাস হিসাবে দুই পূজায় উৎসব-ভাতা দেয়া হয় ৪৭ দিনের মজুরি। যার টাকার পরিমাণ ৫ হাজার ২৪০ টাকা। এর ৬০ ভাগ দেয়া হয় দুর্গাপূজায় এবং ৪০ ভাগ দেয়া হয় ফাগুয়া উৎসবে। এছাড়া সপ্তাহে একবার দেয়া হয় ২ টাকা কেজি দরে সাড়ে তিন কেজি আটা। প্রত্যেক বাগানেই রয়েছে মূল শ্রমিকের প্রায় অর্ধেক ক্যাজুয়াল (অস্থায়ী) শ্রমিক। তাদের বেতন আরো অনেক কম। তাদের জন্য নেই কোনো উৎসব-ভাতা, নেই রেশনও।

চা শ্রমিকদের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য খুবই কম থাকে। তাদের প্রতিদিনকার খাদ্যে রয়েছে সকাল বেলা রুটি-চা বা আলু ভাজি, দুপুরে রুটি তার সঙ্গে আলু সিদ্ধ, পেঁয়াজ ও কচি চা পাতার মিশ্রণে ভর্তা, ঠাণ্ডা চা ও রাতে ভাত। ভাতের সঙ্গে চানার ডাল বা অন্য কিছু।

শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া ডিভিশনের খাইছড়া চা বাগানের শ্রমিক জোৎসনা পাইনকা জানান, তাদের খাদ্যে থাকে সকালে ও দুপুরে রুটি ও রাতে ভাত। ভাতের সঙ্গে চানার ডাল, আলু ভাজি বা অন্য কিছু সবজি। প্রতি বুধবার হাজরি পাওয়ার পর ছোট মাছ কিনেন। কেউ কেনেন শুকনো মাছ। ঠিক কতদিন আগে মাংস খেয়েছেন তা তার জানা নেই। একই বাগানের কুন্তি ভূইয়া জানান, তারা সকালে রুটি করে সবাইকে খাইয়ে নিজের জন্য সঙ্গে করে সেকশনে নিয়ে আসেন। যাদের ঘরে ছোট বাচ্চা আছে তাদের জন্য ভাত রান্না করে রেখে আসতে হয়।

তিনি জানান, বেশির ভাগ সময়ই তারা চানার ডাল খেয়ে থাকেন। যারা নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত অল্প জায়গার মধ্যেই শাকসবজি চাষ করেন তারা তা খেয়ে থাকেন। খাইছড়া চা বাগানের শ্রমিক রাম প্রসাদ বারই জানান, এখন সরকারি কিছু অনুদান ও বেতন কিচুটা বাড়াতে শ্রমিকরা কোনো রকমে ক্ষুধা নিবারণ করলেও একটা সময় প্রতিদিনকার একবারের খাবার ছিল ভাতে ফেন এবং কচু সিদ্ধ। তাদের পূর্ব-পুরুষ প্রতারণায় পড়ে এদেশে আসার পর থেকেই তাদের সংগ্রামী জীবন চলে। একবেলা আধাবেলা খেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারেই কেটেছে তাদের জীবন। ভুড়বুড়িয়া চা বাগানে মুনমুন পাইনকা জানান, পূজার সময় তারা একদিন মাংস খান। ওই সময় বাগান কর্তৃপক্ষ অল্প কিছু বোনাস দেয়। এ থেকেই তারা মাংস খান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App