×

মুক্তচিন্তা

পরিবহনে গণধর্ষণ ও ডাকাতি : ব্যর্থতার দায় কার কতটুকু

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২২, ১২:১৮ এএম

পরিবহনে গণধর্ষণ ও ডাকাতি : ব্যর্থতার দায় কার কতটুকু

গণপরিবহনে ডাকাতি ও গণধর্ষণ প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ঈগল পরিবহনে রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত দুর্ধর্ষ ডাকাতি ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একজন নারী যাত্রীকে ওই সময়ের মধ্যে ছয়বার ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন নৃশংস ঘটনার ৩ দিন পরই গাজীপুর সড়কে স্বামীকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়। কিছুদিন আগে দেখা গেল একজন তরুণী চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করছেন। তারও কিছুদিন আগে সংবাদে প্রকাশিত হলো ঢাকার ইডেন কলেজের এক ছাত্রী নিজেকে রক্ষার জন্য চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে অভিযোগ করছেন। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায় যে, গণপরিবহন যেন ধর্ষকদের নিকৃষ্ট আচরণ প্রকাশের তথা ধর্ষণের নিরাপদ জায়গায় পরিণত হয়েছে। ধর্ষক ও নিপীড়ক পুরুষের কাছে যৌন নিপীড়নের উত্তম স্থান হলো এখন গণপরিবহন। যে কোনো অপরাধমূলক আচরণে অবাধ অভ্যস্থতার জন্য লাগে অপরাধীর নিরাপত্তাবোধ ও সুযোগ এবং অপরাধ সংঘটনের একটি নিরাপদ স্থান। অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত করার পূর্বে উল্লিখিত তিনটি বিষয় সন্ধান করে এবং তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গণপরিবহনে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সহজে করা যায় এবং এতে ছাড় কিংবা পাড় পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খোলা দৃষ্টি মহাসড়কে নেই। থাকলেও যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধানে সক্রিয় উদ্যোগ নেই। যাত্রীদের এমন অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ আছে যে, মহাসড়কে গণপরিবহন, পণ্যবাহী ট্রাক থেকে টহল পুলিশ কেবল চাঁদা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে মহাসড়ক হয়ে ওঠে অপরাধের উত্তম ক্ষেত্র বা জায়গা। আর তাই ডাকাতি ও ধর্ষণের জন্য ডাকাত ও ধর্ষকদের কাছে গণপরিবহন এতটাই নিরাপদ। কী সাংঘাতিক নিরাপত্তাহীনতা যাত্রীদের জন্য গণপরিবহন! বিশেষ করে নারী যাত্রীদের জন্য। দূরপাল্লার পথে যাত্রীরা এক সময় ভাড়ার প্রাইভেটকারে চলাচলে সাহস পেত না নিরাপত্তার প্রশ্নে। অটোরিকশা, রিকশার চেয়ে বাসকেই শ্রেয় মনে করা হতো। কারণ সেখানে অন্যান্য যাত্রীর সমাগম থাকত। একটা সময়ে গণপরিবহন যাত্রীবান্ধব ছিল। অভিভাবকরা তার সন্তানের জন্য নিরাপদ যান হিসেবে গণপরিবহনকেই পছন্দ করতেন। ভাড়ায় সাশ্রয়ী ও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত ছিল গণপরিবহন। দিনে দিনে সেই অবস্থা বিপরীত দিকে পৌঁছেছে। নিরাপত্তার প্রশ্নে, দুর্ঘটনা ও ভাড়ায় গণপরিবহন এখন বেশি অনিরাপদ। ভীতিকর পরিবহনের নাম এখন গণপরিবহন। সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ নারী যাত্রীদের জন্য। কারণ কী, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেটা দেখার প্রয়োজন বোধ সম্ভবত কেউ করেননি। সমাজে কত বুদ্ধিওয়ালা রয়েছেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা রয়েছেন, নারীবান্ধব শ্রেণি রয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণত সমাজে কোনো নেতিবাচক ঘটনা বা আচরণের প্রচলন যখন ঘটে তখন তার কারণ খতিয়ে দেখতে হয়, উৎস খুঁজতে হয় যদি না সমাজ থেকে ওই পচে যাওয়া অংশ কেটে ফেলার প্রয়োজনীয়তা থাকে তথা যদি না সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে হয় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে। অপরাধ বা নেতিবাচক ঘটনা নির্মূলের জন্য ওসব লাগে। নতুবা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেয়া যায় না। নেয়া সম্ভব নয়। যেমন চিকিৎসক আগে রোগের কারণ খুঁজতে থাকেন এবং তারপর তিনি চিকিৎসা পর্ব শুরু করেন। রোগের কারণ না জেনে চিকিৎসা শুরু করলে রোগ নিরাময় হয় না। ফলাফল বিপরীত দিকে যেতে পারে। ভুল চিকিৎসায় প্রাণহানি ঘটতে দেখা যায়। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য যে, সমাজের অসুস্থতার বা সামাজিক ব্যাধির কারণ ও উৎস খুঁজতে হয় প্রকৃতার্থে সমাজকে ব্যাধিমুক্ত করার ইচ্ছে পোষণ করলে বা প্রয়োজনীয়তা বোধ করলে। কারণ অনুসন্ধান না করে উদ্যোগ গ্রহণ নেহায়েত বাকোয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেন গণপরিবহন ডাকাতি ও ধর্ষণের জন্য অপরাধীদের কাছে উত্তম ও নিরাপদ জায়গায় পরিণত হয়েছে তার কারণ খুঁজতে একটা অনুসন্ধানীমূলক গবেষণা বা জরিপ হওয়া দরকার। এতে নিশ্চিত মহাসড়কে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের ভয়াবহ দায়িত্বহীনতা, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অপরাধের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের সম্পৃক্ততা, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার অদূরদর্শিতা ও দুর্বল কাঠামো, পরিবহন মালিকদের যাত্রীদের নিরাপত্তা বিষয়ে দায়বদ্ধতা না থাকা, অতি মুনাফা লাভের ইচ্ছে ইত্যাদি পর্যায়ের কারণ বেরিয়ে আসতে পারে। হয়তো এসব ছাড়া লোমহর্ষক কোনো কারণও বেরিয়ে আসতে পারে, যা কারোর কল্পনার মাঝেও নেই। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি কার ওপর বর্তায়? কার দায়বদ্ধতা এখানে সবচেয়ে বেশি। এক বাক্যের প্রথম উত্তর হলো, পরিবহন মালিকের। তিনি তার যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাথমিক অবস্থায় নিশ্চিত করবেন। উপযুক্ত অস্ত্রসহ তার পরিবহনে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত থাকবেন। পথে পথে যাত্রী তোলার সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া কোথাও বাস থামবে না। বাস স্টপেজে থাকবে উপযুক্ত নিরাপত্তাকর্মী। বৈধ লাইসেন্সসহ মোটামুটি দক্ষ, সৎ গাড়িচালক, হেলপার, সুপারভাইজার নিয়োগ দিতে হবে। অবশ্যই তাদের ডোপ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে, তারা মাদকে আসক্ত নয়। উল্লিখিত কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে না পারলে, নিশ্চিত করতে না পারলে ডাকাতি ও ধর্ষণের দায় বর্তাবে পরিবহন মালিকদের ওপর। এবার আসি মহাসড়কের নিরাপত্তাকর্মীদের কথায়। আমরা জানি যে, জোনভিত্তিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মহাসড়কের কোনো এলাকায় অপরাধ সংঘটিত হলে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেইসব সদস্যের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। দায়িত্ব পালনে তাদের আন্তরিকতা, সক্রিয়তা ও নৈতিকতা দেখার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এখন যেটা চলছে তা কোনোভাবেই যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত ও যুক্তিযুক্ত নয়। অপরাধীদের অপরাধ করার জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ হয়ে আছে মহাসড়কগুলো। এ কারণে সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল মগাসড়কে ৩ ঘণ্টাব্যাপী সংঘবদ্ধ ডাকাতি ও গণধর্ষণ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে অপরাধীরা। নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো হদিস, টহল ছিল বলে মনে হয়নি। এই ক্ষেত্রে তাদেরও আইনের আওতায় এনে দেখা যেতে পারে দায়িত্ব পালনে কোথাও কোনো ত্রæটি ছিল কিনা। পুলিশ সদস্যদের কারো কারো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘটনা কিন্তু রয়েছে। জনজীবনে সামাজিক নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই, হয় না। খেয়ে পরে বেঁচে থাকুক মানুষ সবকিছুর ঊর্ধ্বে সে নিরাপত্তাটুকু চায়। প্রচারমাধ্যমে শোনা গেল, প্রতিটি গণপরিবহনে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য ইতোপূর্বে প্যানিক বাটন লাগানোর কথা ছিল। কিন্তু এটা ব্যয়বহুল বিধায় মালিকপক্ষ অনুরোধ করেছিল দাম কমাতে। বিষয়টি ওই পর্যন্ত গিয়ে থেমে আছে। এতে প্রতীয়মান হয় যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে মালিকপক্ষ বা অন্য পক্ষ কতটা আন্তরিক। সাধারণত গণপরিবহনের যাত্রীরা হলেন সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষজন। যারা ভুক্তভোগী তারাও ওই দুই শ্রেণির। দেশের নীতি-নির্ধারক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা, আমলা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ কেউ গণপরিবহনে চলাচল করে না। সম্ভবত সেই কারণে বিজয়ের ৫০ বছর পর ’৭১-এর আদলে গণপরিবহনে সংঘবদ্ধ গণধর্ষণ হলেও কারোর কিছু যায় আসে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। সাধারণত প্রতিটি ঘটনার পর জানা যায় যে, আটককৃত অপরাধীরা ইতোপূর্বে বিভিন্ন মামলার আসামি ছিল। এমন কথা শোনা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মুখ থেকে। তার মানে দাঁড়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন অপরাধীরা, ইতোপূর্বে অপরাধ করেও তাদের কোনো সংশোধন হয়নি, এটাই সত্য এবং এটাকে মেনে বাকিদের চলতে হবে। ঠিক নয়। যাত্রীরা বাসে উঠতে যেমন টাকা দিয়ে টিকেট কেনে, ঠিক তেমন তারা তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাষ্ট্রকে তার মূল্য পরিশোধ করে। পরিবহন ব্যবসা টিকে থাকে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বেতন হয় এই জনগণের টাকাতেই। সুতরাং হয় অপরাধ থেকে অপরাধীদের মুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে, নতুবা অপরাধ সংঘটিত যেন না হয় সেইদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে এবং গণপরিবহনে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মালিকপক্ষকে সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সমাজ যেন ধর্ষক, ডাকাত, চোর, প্রতারক, বদমাইশের অভয়ারণ্যে উপনীত হয়েছে। পরিশেষে বলব, গণপরিবহনের যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মালিকপক্ষ ও সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যৌথ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উভয়পক্ষকে তার দায় নিতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App