×

মুক্তচিন্তা

‘হাওয়া’ থেকে পাওয়া

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২২, ০৫:৫৭ এএম

হাওয়া সিনেমাটি দেখতে যাওয়ার প্রধান আগ্রহ হলো- কোনো এক সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন আপা বলেছিলেন, তিনি মাঝ দরিয়ায় মাঝিদের ট্রলারে করে গিয়েছিলেন কোনো একটি গল্পের জন্য। জেলেদের জীবনযাপন দেখার জন্য তিনি জেলে পরিবারের সঙ্গে কয়েক দিন সময়ও কাটিয়েছেন কাহিনীকে জীবনতুল্য করার জন্য। যেটা সব কবি লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং মাঝ দরিয়ায় এদেশের জেলেদের জীবন কেমন হতে পারে ‘হাওয়া’ সিনেমার মাধ্যমে দেখে নেয়াই ছিল আমার আসল উদ্দেশ্য। আর আগে থেকে কাহিনী শোনা থাকলে মুভি দেখার আগ্রহ হারিয়ে যাবে- এই ভয়ে কোনো সমালোচনা পড়িনি বা কারো মুখে গল্পও শুনিনি। তাই কাহিনীর শুরুতে হকারের বিজ্ঞ বক্তব্য, মাঝি সর্দারের বগলের চুল কাটার দৃশ্যে নড়েচড়েই বসতে হয়েছে। অর্থাৎ শুরুটা পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন চমৎকার গতিময় করে তুলেছিলেন। চমৎকার কিছু প্রাণবন্ত দৃশ্য ছিল যেমন, বোটে দাঁড়িয়ে সাগরে প্রস্রাব করা, টাট্টিখানায় (টয়লেট) যাওয়া আসার দৃশ্য কাহিনীকে বাস্তবতার ছোঁয়া দিয়েছে। যদিও টাট্টিখানা শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হওয়া। এছাড়াও মাঝিদের মধ্যে রং-তামাশার বিষয়গুলো বাস্তবিক দৈনন্দিন জীবনের গভীর যোগাযোগ ভালো লেগেছে। কিন্তু নারীচরিত্রের উপস্থাপন এবং শেষ পর্যন্ত নারীটির উদ্দেশ্য কাহিনীকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিল বলেই আমার মনে হয়েছে। তবে যদি ‘হাওয়া’ নামকরণের সার্থকতা খুঁজতে যাই, তাহলে সার্থকই বলতে হবে। কারণ ৮-১০ লাখ টাকার মাছ ধরা জালকে আমরা হঠাৎ করেই হাওয়া হতে দেখেছি। অবশ্য সেটা মোটেও অসামঞ্জস্য নয়। কারণ বিশালতম সাগরে একটা জাল কেটে ভাসিয়ে দিলে সেটা খড়কুটোর মতোই হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় স্বয়ং মেয়েটি চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অদ্ভুত। পরিচালক হয়তো চেষ্টা করেছেন নারীর রহস্যময়তাকে অন্যভাবে সৃষ্টি করতে। অর্থাৎ কখনো নারীটি মাছ, কখনো ডলফিন, কখনো অদৃশ্য এবং কাহিনীর একেবারে শেষে এসে বোঝানো হলো, রহস্যের মায়াজালে মেয়েটি আসলে একটি ইচ্ছেধারী নাগিন! এই ধরনের সিম্বোলিক কাহিনী আমার মনে হয়েছে, কাহিনীটিকে হালকা করে দিয়েছে। কিন্তু যদি সারভাইভাল কাহিনী হতো, যেমনটা দেখেছিলাম বিখ্যাত মুভি Life of Pi. এর মূল কাহিনী কিন্তু খুবই ছোট। অথচ টানটান উত্তেজনা এবং কী হয় কী হয় করে ঘটনাটিতে আটকে যাওয়া, তার চেয়েও বড় বিষয় যেটি মাথায় ভর করেছিল তা হলো, সত্যি যদি ভয়াল সমুদ্রে ঝড়ে জাহাজ তছনছ হয়, যদি কোনোক্রমে কেউ বেঁচে যায় তাহলে কী পরিণাম হতে পারে, কী কী বিপদ হতে পারে সেইরকম একটা প্রস্তুতি, সেইরকম একটা বাস্তবিক ভাবনা মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। লাইফ অব পাইতে যেমন ভয়ংকর জীবন যুদ্ধ ছিল, তেমনি ছিল প্রাণীর প্রতি প্রাণীর প্রেম, বিশ্বাস, আস্থার অপূর্ব মোহময়তা। হাওয়ার শুরুতে এমনই একটা আবহ সৃষ্টি হওয়ায় বারবার টাইটানিক এবং লাইফ অব পাই সিনেমার কথাগুলোই মনে আসছিল। এবং হাওয়া চলচ্চিত্রের ছোট ছোট চিত্রগ্রহণ তেমনই অসাধারণ ছিল! নোঙর ফেলা, পানির তলে ইঞ্জিনের স্টার্ট নেয়া, অসীম সাগরে ডিঙির মতো ক্ষুদ্র একটি বোট। আহত লোকটির ক্ষুধা, বিকারে চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, একে-অপরকে অবিশ্বাস করে ভয় পাওয়ার অনুভূতিগুলো ভীষণ জীবন্ত ছিল। পানির অভাবে মাছের বরফ টুকরো খাওয়া। যা নাগিন চরিত্র সৃষ্টি না করেও অন্যভাবে করা যেত। তবে পোষা ময়না পাখিটিকে খাওয়ার দৃশ্যটি ছিল ভীষণ কুৎসিত। যদিও এ ঘটনা দিয়ে মাঝির হিংস্রতাকেই তুলে ধরা হয়েছে এবং চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় ছিল অসাধারণ! এখানে আরেকটি বিষয় আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে যে, মাঝ সমুদ্রে দিক হারানো নাবিক তার পোষা ময়না পাখিটিকে ছেড়ে দিল এটা ঠাওর করার জন্য যে, তারা উপকূলের কাছাকাছি আছে নাকি দূরে সেটা? পাখিটি ফিরে এলে বুঝতে হবে কূলকিনারা নেই। আর না ফিরে এলে বুঝতে পারবে খুব দূরে নয় সমুদ্র উপকূল। এ ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি, একটা সময় দিক হারানো মানুষ এভাবেই সমুদ্রযুদ্ধ করেছে, জয়ও করেছে, অসাধারণ ছিল এই উপস্থাপন এবং পাখিটি কূলকিনারা না পেয়ে জান বাঁচানোর জন্য আশ্রয়ের জন্য জাহাজে ফিরে এসে মাঝির উপকার করলেও প্রতিদানে সে খাদ্য হলো মাঝির! বিষয়টি সত্যি গভীর। এবার আসি গালিগালাজ প্রসঙ্গে। একটা শ্রেণির সহজ সাবলীল প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমই এই ভাষা। যা ছড়িয়ে আছে পথে ঘাটে, রিকশাওয়ালা থেকে ভ্যানওয়ালা, ট্যাক্সি চালক, তরকারিওয়ালার ভাষায়। তাই বিষয়টি বাড়াবাড়ি বা অস্বাভাবিক লাগেনি। ছোট ছোট বাস্তব চিত্রয়াণের মাঝে সিনেমার মূল থিমটা অবাস্তব হয়ে শেষে খিচুড়ি হয়ে যাওয়ায় ভালো লাগেনি। নারীচরিত্রটি না ভৌতিক, না বাস্তব! মেয়েটি হাওয়া হয়ে এসে সাপ হয়ে পাহারা দেয় নায়ককে এবং তার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পর মৃত নায়কের শরীরকে আলিঙ্গন করে আবার নারী রূপে ফিরে আসা, এই শতাব্দীতে এসে ‘ইচ্ছেধারী নাগিন’ চরিত্র মেনে নেয়া যায় না। সারভাইভাল কাহিনী হতে হতে হয়ে গেল অবাস্তব একটি কাহিনী, যা হাওয়া থেকে পাওয়া। শুধু বিনোদন হিসেবে সিনেমাটি দেখলেও বলব চমৎকার, দেখেই আসুন হলে গিয়ে। চন্দ্রশিলা ছন্দা কবি ও লেখক, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App