×

অর্থনীতি

ডলারে বেসামাল অর্থনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪৬ এএম

১২০ টাকা দিয়েও পাচ্ছেন না গ্রাহক > ৬ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ

দেশের অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এ মুদ্রার দাপটে বেসামাল অর্থনীতি। চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না ডলার। আমদানি ব্যয় কমাতে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ, বাড়ছে রপ্তানি, রেমিট্যান্স। তবুও পাগলা ঘোড়ার মতোই যেন ছুটছে ডলারের দাম; কমছে টাকার মান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানা উদ্যোগেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। খোলাবাজারে ডলারের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ১২০ টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না গ্রাহক। দেশে মুদ্রাবাজারের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের এতটা অবমূল্যায়ন আগে হয়নি। ডলারের এ সংকটে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে পণ্যের দাম। বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতির পারদকে আরো উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় অনেকে শেয়ার বিক্রির টাকা ডলার মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপে ডলার বাজারে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এজন্য স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে সম্পদ হিসেবে ‘অ্যাট্রাক্টিভ’ করতে হবে। কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলেন, বিভিন্ন তদারকির নামে হয়রানি হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হচ্ছেন বিদেশ থেকে আগত ডলার বিক্রেতারা। ফলে আরো বেশি সংকট তৈরি হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মানি এক্সচেঞ্জার বলেন, যেভাবে মনিটরিংয়ের নামে মানি এক্সচেঞ্জগুলোর দরজায় এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে বিদেশ থেকে আগতরা ডলার বিক্রি করতে আসতে ভয় পান। এর মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগের মনিটরিং খুব খারাপ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজার তদারকির ব্যবস্থায় আরো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে আমার ইতিবাচক মতামত নেই। বাজার তদারকি বা অভিযান চালিয়ে আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজার বিশেষ করে চালের দামের বাড়তি প্রভাব কমাতে পারিনি। ডলারের সমস্যা সমাধান করতে হলে বাজারে ডলার সাপ্লাই বাড়াতে হবে। এছাড়া বাজারের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বসতে হবে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স বেশি আসার পরেও কেন ডলার সংকট তৈরি হচ্ছে জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, রেমিট্যান্স ডলারের কোন রেট ধরে দেশে আসছে, সে বিষয়টিও দেখতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি। বাংলাদেশের মুদ্রার এত পতন কখনই কাম্য নয়। আমরা মনিটারি পলিসিকে কাজে লাগাইনি। সেজন্যই আজ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, মোটা দাগে ব্যাংকের সুদহার বাড়াতে হবে। টাকাকে আকর্ষণীয় করতে হবে। মূল্যস্ফীিতর তুলনায় আমাদের আমানতে সুদহার কম। সুতরাং টাকাকে সম্পদ হিসেবে দামি করে তুলতে হবে।

সূত্রমতে, ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোয় ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়। গত সপ্তাহ পর্যন্ত কারসাজির অপরাধে পাঁচ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ৪২টিকে শোকজ করা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করায় নয়টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডলার মজুদ করে মুনাফা করার প্রমাণ পাওয়ায় এরই মধ্যে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের বাজার। গতকাল বুধবার দুপুরে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার রেকর্ড ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগের দিন মঙ্গলবার বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে ২৫ টাকা বেশিতে খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে মুদ্রাটি। এর আগে ২৭ জুলাই খোলাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ১১২ টাকা। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির পর কয়েক দিন সেখান থেকে কিছুটা কমে ১০৮ টাকায় থিতু হয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে আবার শুরু হয় ঊর্ধ্বগতি। গত সোমবার খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয় ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায়। এদিকে বাড়তি দামেও খোলাবাজারে চাহিদামতো ডলার মিলছে না। রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন এলাকার বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জার ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।

গ্রাহকদের ডলারের পরিবর্তে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমানে যেহেতু ক্যাশ ডলারের সংকট রয়েছে, তাই এ সময় স্টুডেন্ট ভিসায় বা চিকিৎসার কাজে যারা বাইরে যাচ্ছেন তারা যদি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের কাজটাও সহজ হবে এবং তারা বেশি লাভবান হবেন। এই বিষয়ে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকদেরও উদ্যোগী হতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ।

এদিকে গত এক মাসেই কোনো কোনো ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে চার গুণ মুনাফা করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ কারসাজিতে দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংক জড়িত। এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ডলার কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে শুধু ট্রেজারি প্রধান নন, ব্যাংকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরের বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। তখন ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ও খোলাবাজারের দরের মধ্যে পার্থক্য ছিল কমই। বরং গোটা বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে দর ধরে রাখতে চেষ্টা করেছে। তবে মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্য, জ্বালানি, শিল্পের উপকরণের দর বেড়ে যাওয়ায় ডলারের সংকট দেখা দেয়। আমদানি খরচ বাড়ায় চলতি বছরের মে মাস থেকে দেশে ডলারের সংকট চলছে। এর ফলে বেড়ে গেছে ডলারের দাম।

ডলারের সংকট শুরু হলে গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শক দল দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলোয় পরিদর্শন করে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের যে ঘোষণা দিয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে কেনাবেচা করছে। ডলার কেনাবেচায় দামের পার্থক্য (স্প্রেড) তিন টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আবার অনেক ব্যাংক ডলার ধারণের মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এর মাধ্যমে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে ট্রেজারি বিভাগ মুনাফায় অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর জবাব চেয়ে চিঠি পাঠায় বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার ছয় ব্যাংকের এমডির কাছে পাঠানো চিঠিতে ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

ব্যাংক ছয়টির এমডিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লিখেছে, ‘২০২১ সালের জানুয়ারি-মে মেয়াদের তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে উচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য বৈদেশিক বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। এজন্য আপনাদের ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে এক মাসে চার গুণ মুনাফা করেছে। যার মাধ্যমে ডলারের বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তোলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত এক দশকে একসঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। ২০০২ সালে ওম প্রকাশ আগরওয়াল নামের এক ব্যবসায়ী জালিয়াতির মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ওই ঘটনায় একসঙ্গে পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডলার বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে কয়েকটি ব্যাংক। এজন্য তাদের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ডলার সংকট ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে বাংলাদেশ মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছি। অনেকের কাছ থেকে শুনছি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা, ১১৭ টাকা ও ১২০ টাকা। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে ১১২ টাকার বেশি দরে ডলার বিক্রি করব না। এটার বাস্তবায়ন রয়েছে সব হাউসে।

তিনি বলেন, এখন ডলার বিক্রি আর আগের মতো নেই, নগদ ডলারের সংকট রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযান শুরুর পর থেকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এখন চাইলেও যে কেউ এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো থেকে ডলার নিতে পারছেন না। এখন অবশ্যই পাসপোর্ট-ভিসা দেখাতে হবে। তবে খুচরায় বেশি দাম নেয়া হচ্ছে কিনা জানা নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App