×

জাতীয়

জ্বালানি তেলের প্রভাব বাজারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২২, ০৮:১৫ এএম

জ্বালানি তেলের প্রভাব বাজারে

ছবি: ভোরের কাগজ

পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের > বাড়তি ব্যয়ের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর গণপরিবহন থেকে নিত্যপণ্য সব কিছুর পেছনেই বাড়তি ব্যয় বইতে হচ্ছে ভোক্তাদের। সবকিছুর দায় ঠেকেছে সাধারণ মানুষের ওপর। গত শুক্রবার রাতে হঠাৎই দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন দাম বাড়ে জ্বালানি তেলের। এর সঙ্গে সঙ্গেই যেন হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। দাম বেড়েছে শাকসবজি, মসলা জাতীয় পণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের। এদিকে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে ক্রেতা, বিক্রেতা এবং আড়তদারদের মাঝে বাকবিতণ্ডা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন এমনিতেই সংকটে পড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আগে থেকেই অস্থির দেশের বাজার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে এ পরিস্থিতি আরো উসকে দিয়েছে সরকার।

রাজধানীর কয়েকটি বাজারে গতকাল সোমবার ক্রেতা, বিক্রেতা ও আড়তদারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আড়তদাররা বলছেন, তেলের দাম বাড়ার পর প্রতি পিকআপে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে জিনিসপত্রের। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্রেতারা। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, গত তিন মাসের মধ্যে মে মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জুন মাসে ৬ দশমিক শূন্য ৪৭ শতাংশ এবং জুলাইয়ে বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে, এ তিন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, ৭ দশমিক ৫৬ এবং ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরির সূচক স্থির থাকলেও স্থির থাকেনি মূল্যস্ফীতির সূচক। খাদ্যপণ্যের দাম মেটাতে নিজের সব আয় বিসর্জন দিচ্ছে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো। সঞ্চয়ের হিসাব ভেঙে দিন কাটাচ্ছে মধ্যবিত্ত মানুষ। সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা- সব কিছুর দাম বেড়েছে, বাড়ছে না শুধু বেতন।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, একসঙ্গে এত দাম বাড়ানোর কারণে মানুষের জীবনে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমনিতেই ৮ শতাংশের কাছাকাছি মুদ্রাস্ফীতি। এটা ডাবল ডিজিটে চলে যেতে পারে। মানুষের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে যাবে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম যা বেড়েছে, সেটা অপ্রত্যাশিত। এতটা বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি। মানুষের কল্যাণ দেখতে হবে আগে। মানুষ কতটা বোঝা বহন করতে পারে, এর মাধ্যমে বোঝা অতিরিক্ত হয়ে গেল। এর ফলে সরকারের যত অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে।

সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিআরটিএর মাধ্যমে ভাড়া বাড়িয়ে নেন গণপরিবহনের মালিকরা। ৯ মাসের মধ্যে ভাড়া বাড়ার হার ১৭ থেকে ২২ শতাংশ। এদিকে তেলের বাড়তি দাম যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। আড়তগুলোতে বেড়েছে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ সব ধরনের পণ্যের দাম। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খুচরা বাজারে। আড়তগুলোতে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২ টাকা। রসুন এবং আদার দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে প্রায় ৩ থেকে ৫ টাকা। আলুর দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা প্রতি কেজিতে। সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ সবজিরই দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। খুচরা বাজারে যা ঠেকেছে ১০-২০ টাকায়।

বাজার করতে আসা মগবাজারের বাসিন্দা রাশেদুল আলম বলেন, নানা বাহানায় একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ছে গণপরিবহন, দ্রব্যমূল্যসহ বহুমুখী ক্ষেত্রে। কিন্তু বাড়ছে না আয়ের উৎস। এর আগে গত জুনে গ্যাসের দাম বেড়েছিল ২৩ শতাংশ। আবার বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ার ঘোষণাও আসতে পারে যে কোনো সময়। মালিবাগ কাঁচা বাজারের আড়তদার মোহাম্মদ মনির বলেন, এমনভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গাড়ি ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ১৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া লাগত সেখানে এখন ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া লাগছে।

বাজারে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা আবার কোথাও কোথাও এ দাম ৫০ টাকাও ছাড়িয়েছে। কেজিপ্রতি আদা বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকায় এবং রসুন ৯৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা। অন্যদিকে একই অজুহাতে বেড়েছে সবজির দাম। বেগুন ৫০ টাকা, করলা ৫০ টাকা, কাকরোল ৪০ টাকা, ঝিঙা ৫০ টাকা ও শসা ১২০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সবজির মধ্যে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁপে। পাঁচ টাকা বেড়ে সোমবার বাজারে এক কেজি পেঁপের দাম ৩০ টাকা। ৩৫ টাকা কেজির পটল ও ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। অর্থাৎ ১৫ টাকা বেড়েছে। ৪৫ টাকার শসা বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা কেজিতে। ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া চিচিঙ্গা, ধুন্দল, কাঁকরোল ও কচুর মুখি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। একই দামে বিক্রি হচ্ছে রববটি। ৬০-৭০ টাকার উচ্ছে-করলা, বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। বাজারে নতুন আসা শীতকালীন সবজি শিম ২০০ থেকে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া টমেটো ১২০ টাকা ও প্রতি কেজি গাজরের দাম ১৪০ টাকা। লাউ ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ টাকা ও চাল কুমড়া ৪০ টাকা পিস হিসেবে এবং মিষ্টি কুমড়ার ফালি ৩০ টাকা, কাঁচকলা ৩০ টাকা ও লেবু ১৫-২০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে। শান্তিনগর কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতারা বলেন, দাম বেশি থাকায় এক পাল্লা-দুই পাল্লা করে মাল আনতে হয়েছে। কারণ, দাম বেশি হলে বিক্রি কম হয়।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে মাছের বাজারেও। কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তে প্রায় সব ধরনের মাছের দামও বাড়তি। মাছ ব্যবসায়ীরা বলেন, ট্রাকের ভাড়া বাড়ায় সব ধরনের মাছের কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বাড়িয়েছেন তারা। তাদের ভাষ্য মতে, ঢাকার ভেতরে এক বাজার থেকে আরেক বাজারের ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তবে পণ্য পরিবহন খরচ আগের মতোই রয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ কাভাডভ্যান ট্রাক মালিকদের।

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে কেজিতে অন্তত ৪ টাকা বেড়েছে চালের দাম। বর্তমানে মোটা জাতের ইরি-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৪-৫৫ টাকায়। ইরি-২৯ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭০ আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, পাইকারি বাজার থেকেই বেশি মূল্যে কিনে আনতে হচ্ছে চাল। মেমো অনুযায়ীই দাম নিচ্ছেন তারা। লোডশেডিংয়ের কারণে মিল পর্যায় থেকে ট্রাক প্রতি চালের ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মিল থেকে আসা নতুন চাল বস্তা প্রতি দাম বাড়তে পারে ১০০-২০০ টাকা।

এমন পরিস্থিতিতে সীমিত আয়ের মানুষের মাঝে ফুটে উঠেছে ভোগান্তির চিত্র। একদিকে সরকার বলছে মিতব্যয়ী হতে, অন্যদিকে এক বেলার খাবার জুটানোও কঠিন হয়ে পড়েছে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App