×

মুক্তচিন্তা

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানি হলে সহনীয় হতো

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২২, ০১:৫৩ এএম

বাংলাদেশে ৬ আগস্টের মধ্যরাত থেকে রেকর্ড পরিমাণে বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৪, অকটেন ৪৬ এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮ শতাংশ, প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হবে ১৩৫ টাকা। বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি করা ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫-৮০ টাকা করে সরকার। তবে অকটেন ও পেট্রোলের দাম অপরিবর্তিত ছিল। এবারে বৃদ্ধি অভূতপূর্ব। আগে কখনো হয়নি। কিন্তু হওয়ার ছিল। সবমিলে বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি করা মোট জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। প্রায় ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। শিল্প খাতে ৭ ও বিদ্যুৎ খাতে ১০ শতাংশ তেল ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন গত ৬ মাসে জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কারণ সরকারি ভর্তুকি। পাম্পে পেট্রোল বা ডিজেল কিনতে একজন ক্রেতা যে দাম দেন সেটা পাঁচজনের মধ্যে ভাগ হয়- তেল কোম্পানি, সরবরাহকারী, তেল শোধনাগার, পেট্রোল পাম্পের মালিক ও সরকার। সরকার কেনে অশোধিত তেল। কিন্তু পেট্রোল বা ডিজেলের প্রকৃত মূল্য আসলে ক্রেতা যে দামে কিনছেন তার অর্ধেকের বেশি। অশোধিত তেল কেনা, সেটা পরিবহন করা, আরো প্রক্রিয়াজাত করা, কোথাও জমা রাখা, প্রশাসনিক কাজ এবং বিতরণ করা- এর মধ্যে পড়ে। কাজেই অশোধিত তেল শোধিত হয়ে যখন ক্রেতার কাছে পৌঁছায় তখন তার দাম দ্বিগুণ হতে বাধ্য। এতদিন বাংলাদেশ সরকার যে ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু রেখেছিল তা ক্রমেই সহনশীলতার বাইরে চলে যাচ্ছিল। প্রতিদিন এই ভর্তুকি বাবদ ৯০ কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল রাষ্ট্রের। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছিল। এর আগে গত নভেম্বরে সরকার ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ। সরকারি কোম্পানিগুলোর আবেদনের পর গত ৫ জুন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়। গ্যাস বিল ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়। বিইআরসির কারিগরি কমিটি পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে গত মে মাসে, যার ওপর এ মাসেই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। অর্থাৎ শক্তি সংক্রান্ত সব কিছুরই দাম বাড়াতে চলেছে সরকার। কারণ ক্রমেই ভর্তুকি তুলে দিতে চাইছে। ভারতে ২০১০ সাল পর্যন্ত জ্বালানিতে ভর্তুকি দিত। যার ফলে সরকারই ঠিক করত খুচরা বাজারে কত দাম হবে পেট্রোল-ডিজেলের। কিন্তু ভর্তুকি দেয়ার দরুন রাজকোষে যেমন ধাক্কা লাগে, রাজনৈতিক কারণেও ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে সরকারের কাছে। তখন দেশে প্রায়ই দাবি উঠত, লাগাতার পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমানোর। সেই পরিস্থিতিতে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকার পেট্রোল থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে দেশের জ্বালানির দাম। মনমোহন সিংয়ের দেখানো পথে ২০১৪ সালে ডিজেল থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। তখন মাসের ১ তারিখ ও মাসের ১৬ তারিখে খুচরো পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বদলাত। কিন্তু এই প্রক্রিয়া কার্যকরী না হওয়ায় ২০১৭ সালের ১৬ জুন কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভর করে রোজ বদলাবে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম। কিন্তু তাতে আদৌ কি কোনো লাভ হয়েছিল জনগণের? একেবারেই না। গত বছরের জুন মাসে বিশ্ববাজারে ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম হয়েছিল ৩৫.৪৪ ডলার। ২০২০ সালের জুন থেকে ২১.৯০ ডলার কম। কিন্তু ভারতে পেট্রোলের দাম কমা তো পরের কথা উল্টে বেড়েছিল। কেন এই উলট পুরান? পেট্রোল-ডিজেলের দাম নির্ভর করে বিশ্ববাজারের ওপর। সেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু সূ² স্তরে সরকারই বকলমে নিয়ন্ত্রণ করে জ্বালানির দাম। শুল্ক চাপিয়ে সরকারই ঠিক করে বাজারে জ্বালানির দাম কত হবে। তাই গত বছর জুন মাসে যখন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ‘নেগেটিভে’ চলে যায় তখন পেট্রোলে লিটার প্রতি ১৩ টাকা ও ডিজেলে লিটার প্রতি ১০ টাকা আন্তঃশুল্ক চাপিয়ে দেয় কেন্দ্র। ফলস্বরূপ দাম না কমে উল্টো বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পরই পেট্রোল-ডিজেলে রেকর্ড শুল্ক বৃদ্ধি করেছে কেন্দ্র। কেন্দ্র জ্বালানি থেকে যখন ভর্তুকি তুলে নেয়, তখন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, কেন্দ্র ভেবেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে তাই আর ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন নেই। দেশের হাঁড়ির হাল দেখলে বোঝা যাবে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি তো পরের কথা কর্মহীন হয়ে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার গোটা ভারত। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশে। বাংলাদেশের বাজারে এখন চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, টুথপেস্টসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশি। গত মে মাসের পর ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১০৮ টাকায় উঠে যাওয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়ছে। এমন অবস্থায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে বড় সংকটে ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উন্নয়নের মূল কথাই হলো, যত বেশি জ্বালানি, তত বেশি বিদ্যুৎ, তত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি কর্মসংস্থান, বেকারত্বের অবসান, উৎপাদন উন্নয়ন, সর্বোপরি জাতীয় প্রবৃদ্ধি। করোনা ও বৈশ্বিক যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক ধীরগতি, কর্মসংস্থানহীনতা, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি এই নির্দেশনা দেয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই স্থবিরতা থেকে বেরোতে চাইছে বাংলাদেশ। তবে জ্বালানি তেলের দাম গণশুনানি করে বাড়ালে তা সহনীয় থাকত। সরকার বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, পরিবহন মালিক সমিতি, ট্রাক মালিক সমিতির সঙ্গে ডিজেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আলোচনা করলে অবশ্যই ভালো করত। ডিজেলের ক্ষেত্রে কৃষিতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু কীভাবে? কারণ জ্বালানি তেল বিক্রি, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং তেলের ব্যবহারকারীদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচাবেন কীভাবে? জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বাস, লঞ্চ ও ট্রাকভাড়া বাড়বে। প্রাইভেট কারের মালিক ও মোটরসাইকেলের চালকদের খরচও বাড়বে। ব্যয় বাড়বে কৃষি খাতে, যা বাড়িয়ে দেবে পণ্যের দাম। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা জেনারেটর চালানোর খরচ বেড়ে যাবে, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পেও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আঁচ পড়বে। মাছ ধরা ট্রলারগুলোরও জ্বালানি ডিজেল, তাই সেখানেও খরচ বাড়বে। কৃষিক্ষেত্রে সেচ পাম্প ও পাওয়ার টিলারে ডিজেল ব্যবহার হয় বলে কৃষকেরও ব্যয় বাড়বে। তবুও বলতে হয় এছাড়া সরকারের সামনে কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সে শর্ত পূরণ করা হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে চীনের কাছে ঋণ। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি গাড়িতে ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আসবে। ভারতে ইতোমধ্যে ইলেকট্রিকাল ভেহিকল ইন্ডাস্ট্রি খুব দ্রুত বাজার ধরে নিচ্ছে। ভারতে বিদ্যুৎচালিত ওজনে হালকা ছোট গাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ, জাপান বা কোরিয়ার ব্যবহৃত ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশের সময় হয়েছে দেশের মাটিতে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার। কিন্তু পেট্রোল, ডিজেল, অকটেনের মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী হলেও মুশকিল এক জায়গায়। মূল্য সংযোজন কর। এই কর সরকার কতটা বসাবে, কমাবে বা বাড়াবে তার ওপরে নির্ভর করছে আমজনতার ভবিষ্যতের অবস্থা। বাংলাদেশে বিরোধীকণ্ঠ প্রায় নেই। কাজেই সবটাই নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপরে। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App