×

মুক্তচিন্তা

কত রংবেরঙের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২২, ০১:৫৩ এএম

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অভিযোগ নতুন নয়, কমও নয়। অনেক নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রূপ আর বাইরের রূপের পার্থক্য আকাশ ও পাতালের মতো। এই যখন ‘নামিদামি’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনোটির অবস্থা, তখন নামধাম খুব একটা উচ্চারিত না হয়েও যখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী, সমাবর্তন, বাহারি নামের বিভাগ অনুষদ ইত্যাদির কথা মিডিয়াগুলোর কল্যাণে শোনার সুযোগ ঘটে তখন কেউ কেউ বিস্মিত হলেও এখন এই শব্দটি বোধহয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে বাদ দিয়ে দিলেই ভালো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি অনেক বড় ওজনদারি। একসময় কলেজের নাম শুনলেই মানুষ শ্রদ্ধা এবং ভয়ে কিছুটা অবনত হয়ে যেত। আমাদের জাতীয় জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক মাত্র শত বছরের ব্যাপার। তাও প্রায় তিন দশক ছিল মাত্র ১টি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর দশকে ১-২টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘটনা ঘটেনি। ’৯০-এর দশক থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন শুরু হতে না হতেই আলু, পটোল, পেঁয়াজ, রসুন বিক্রির চাইতেও লাভজনক হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসাও দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। একই ভবনে ২-৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলতেও দেখা গেছে। অনেকটা যেন কিন্ডারগার্টেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যদিও কিন্ডারগার্টেন শব্দটির অর্থ শিশুদের বাগান। যারা শিশুদের জন্য বাগান তৈরির মাধ্যমে শিক্ষাকে আনন্দ ও খেলাধুলার মাধ্যমে দেয়ার দর্শন থেকেই কেজি স্কুল ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তাদের দর্শনটা বাদ দিয়ে নামটা হাওয়ায় উড়িয়ে এনে মুরগির খামারের মতো বন্দি জীবনের এক শিক্ষা বাণিজ্য চালু করতে বঙ্গদেশের বণিকতন্ত্রীরা বড়ই কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছে! পাশ্চাত্যের নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ধার করে একটু বড় ব্যবসায়ীরা হাটে ঘাটে, আনাচে-কানাচে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কম ‘রংবেরঙের’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেননি! দারুল এহসান নামক একখানা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে কতজন কত জায়গায় মারামারি করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একসময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লাভের জন্য ইন্টারভিউ দিতে দেখেছি। বিএড, লাইব্রেরি সায়েন্স ইত্যাদি ডিগ্রিতে উত্তীর্ণ এসব চাকরিপ্রার্থীকে যখন জিজ্ঞেস করা হতো প্রাপ্ত ডিগ্রিটার বানানটি ভালো করে লিখতে পারেন তো? অনেককেই কলম হাতে নিয়ে কলম ভাঙার অবস্থাতেও পড়ে যেতে দেখেছি। অনেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অনেক জায়গায় ‘শিক্ষকতা’ এবং ‘লাইব্রেরিয়ান’ পদের চাকরিটাও পেয়ে গেছেন। এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলোর নাম খুব বেশি শোনা যায় না। কিন্তু সমাবর্তন হলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে দেখেছি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ খুঁজলে দু-একটা পাওয়া যেত। সেগুলোতেও আবার বসা থাকতেন ‘সম্মানিত’ প্রশাসক- যিনি ‘একের ভেতর বহু’ দায়িত্বের অধিকারী ছিলেন। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আসতেন, টাকা-পয়সা জমা দিতে। ক্লাস কিছু হতো, বাধ্যবাধ্যকতা ছিল না বা এখন নেই। এমনও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এখনো আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই ঝরে গেছে, নতুন সাইনবোর্ড উঠেছে। রাতের বেলা বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড যেমন ঝলসানো আলোয় জ্বলে তেমনি বাহারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি কেবল রাতের বেলাই জ্বলতে দেখা যেত। দিনের বেলা সেখানে কিছু শিক্ষার্থীর আনাগোনা, আড্ডা ইত্যাদি দেখা গেলেও শ্রেণিকক্ষের সুবিধা সেখানে খুব বেশি থাকার কথা নয়। এরকম অবস্থা বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ছিল। এখনো কিছু কিছু আছে। তবে এখন কোনো কোনোটির দেহ এবং স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন ঘটলেও লেখাপড়ার পরিবেশ কতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পেরেছে সেটি কেবল সাক্ষাতে গিয়েই দেখা যেতে পারে। এ তো গেল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা রঙের কিছু উপাখ্যান। তারপরও ছাত্রছাত্রীর অভাব এদের খুব একটা হয় না। কারণ পয়সা নাকি খুব বেশি দিতে হয় না। সার্টিফিকেট তো পাওয়া যায়। পড়ালেখা হবে কীভাবে সেখানে? শিক্ষক কোথায়? এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগ চলে নামমাত্র। মেধাবীদের নেয়া হয় না, বলা হয় তারা থাকবে না। থাকবে কীভাবে? পড়ালেখার চর্চা হলেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষক নিজের একটি পেশা খুঁজে পেত। মেধাবী একজন শিক্ষকের জন্য অবশ্যই ভালো বেতন দিতে হবে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই রয়েছে যেখানে ভালো বেতন নেই, ভালো শিক্ষকও নেই। সুতরাং নামমাত্র কিংবা কম বেতনে যারা পড়াতে এসেছেন তারা একান্তই পেটের দায়ে পড়েই এসেছেন। অথচ ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে ৩-৪ বার শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মালিকরা টাকা ঠিকই গুনে গুনে নিয়ে যাচ্ছে। তেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা তো একবারে কম নয়। গণমাধ্যমে ৩০-এর অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়েছে যেগুলোতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নেই। তবে ট্রাস্টি বোর্ড নামে একটি ভারি শব্দযুগলের আওয়াজ কানে বিঁধবেই। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সর্বেসর্বা। তিনি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারারের চেয়েও বড়। আবার কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকও বটে। পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহকারী থেকে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হওয়ার দীক্ষা নিচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কি শিক্ষার্থীরা জানে না? অবশ্যই জানে। তাদের ওসব বিষয়ে জানাজানির কি খুব দরকার আছে? তারা জানতেও খুব বেশি চায় না, আসেও না। তাদের প্রয়োজন সার্টিফিকেটের। সার্টিফিকেট হলে পরিচয়টা দেয়া যায়। সমাজে বলা যায় যে, ও একজন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। সার্টিফিকেটটা হলে অনেকের বিয়ের বাজারে মূল্য ভালো হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য করে উন্নতি করতে পারলে পরিচয়টাও দেয়া যায় যে তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যবসায়ী। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এরা খুব একটা অবতীর্ণ হতে যায় না। নামিদামি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেগুলোর কথা ভিন্ন। সেগুলো থেকে পাস করে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান। অনেকেই অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসেবে অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য বা কিছু একটা পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। কিন্তু যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নেই, শিক্ষকও তেমন নেই- সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় পাশের একটা সার্টিফিকেট তো অন্তত অর্জিত হয়। এটিই বা মন্দ কিসে? তবে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন যখন করে, তখন সমাবর্তন শব্দটিও বোধহয় শিক্ষার জগতকে ব্যঙ্গবিরূপ করার কথা বলতে চায়। সমাবর্তনের নামে একদিকে প্রচারণা চলে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘কোষে’ মোটা অঙ্কের অর্থও জোটে। এখন কথা হচ্ছে এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন কীভাবে হয়- এই প্রশ্নের আমরা উত্তর দিতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মাথা নাড়াচাড়া করছে। কিন্তু মঞ্জুরি কমিশনের তেমন ঢাল-তলোয়ার আছে কি? ঢাল-তলোয়ার থাকলেও তো চলবে না। বেসরকারিরা এসব ‘ম্যানেজ’ করতে খুব ভালো জানে। জানে বলেই তো এত বছর ধরে তারা নানা নামে নানাভাবে টিকে আছে, বেশ ভালো অঙ্কের অর্থও তারা ‘উপার্জন’ করে নিচ্ছে। সম্প্রতি ইউডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের আয়োজন যখন শেষ পর্যায়ে, তখনই শিক্ষামন্ত্রী অবগত হলেন যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার নেই। তিনি সমাবর্তনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পর সমাবর্তন বাতিল হয়ে গেল। ২ হাজার শিক্ষার্থী নাকি সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করার জন্য ঢাকায় চলে এসেছিলেন। এরপরই তাদের মাথায় বজ্রপাত। টাকা গেল, সমাবর্তনের কালো গাউনও পরা হলো না। তবে টাকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে ঠিকই জমা হয়ে গেল। কিন্তু ভাবতে পারেন কি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার শিক্ষার্থী সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছে, অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নেই। না থাকা নিয়েও মালিকপক্ষের নানা খোঁড়া যুক্তি আছে। যেমন হাট বাজারে বিক্রেতারা দাম বৃদ্ধির নানা অজুহাত দিয়ে থাকে। অজুহাতের কত হাত তা কে জানে? তবে অজুহাতের সবচাইতে বড় হাত হলো কালো হাত। ডান হাত, বাম হাত, দক্ষিণ হাত ইত্যাদির কথা নাইবা বললাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকই এখন নানা অজুহাতেই চলছে। শিক্ষা সে তো অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। শুধু বেসরকারি থেকেই নয় অন্য যত ধারার যত শিক্ষা আছে, সর্বত্রই শিক্ষাটা নামে আছে, বাস্তবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেছে। বেসরকারিগুলো কতটা আর রাষ্ট্রের দরকার পূরণ করবে সেটিই বোধহয় মস্ত বড় প্রশ্ন। ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো দরকার এরা পূরণ করছে কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য এরা বড়ই বেদরকারি হয়ে পড়েছে। কারণ এমন ‘শিক্ষার’ কি খুব বেশি দরকার আছে? কিন্তু দরকার থাকুক বা না থাকুক নানা রংবেরঙের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড তুলে নেয়ার শক্তি বোধহয় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সে কারণেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে এমন তামাশা তিন দশক ধরে আমরা যথেষ্ট চালিয়ে যেতে পেরেছি। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সেটিকে হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে, অভিধানে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে। অন্যদের প্রয়োজনটা কোথায়? মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App