×

আন্তর্জাতিক

সিরিজ দুর্নীতির অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গে বিপাকে মমতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২২, ১০:২৬ এএম

সিরিজ দুর্নীতির অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গে বিপাকে মমতা

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

দুর্নীতি আর হঠাৎ আয় বিরাট বৃদ্ধির তদন্তে সংখ্যা বাড়ছে দিনের পর দিন। উল্টোদিকে দুর্বল বিরোধী। তবুও মহা ফ্যাসাদে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। সৌজন্যে সিরিজ দুর্নীতির অভিযোগ। বিরাট জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শাসন ক্ষমতায় ফিরে এতটাই নাস্তানাবুদ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন দল তৃণমূল কংগ্রেস দলের নেতাকর্মীরা আগের মতো প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি থেকে দলীয় কর্মসূচি বিরাট বহরে করতে পারছেন না। নেতাদের দেখলেই সংবাদ মাধ্যম দুর্নীতি ইস্যুতে প্রশ্ন করছে আর অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন নেতারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে উচ্চ নেতৃত্ব সব ধরণের দলীয় কর্মসূচী বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নিচু তলায়। সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলায় সেন্সর করেছে জাতীয় মুখপাত্র কুণাল ঘোষকে।

ইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে গৃহবধূর জুতা নিক্ষেপের পর পশ্চিম মেদিনীপুরের ভগবানপুরে তৃণমূলের টিকিটে জেতা পঞ্চায়েত সদস্যের পরিবারের ওপর টাকা দিয়ে চাকরি না পাওয়া প্রতারিতদের হামলা, বীরভূম জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মন্ডলকে উদ্দেশ্য করে মোহাম্মদ নাসির নামের এক নাগরিকের গোরু চোর স্লোগান দেওয়ার ঘটনা দেখে বিশ্লেষকরা মনে করছেন জনরোষ ও জনক্ষোভের ঘটনা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে যে কোনও মুহূর্তে।

অন্যদিকে সোমবার জানা গেছে, ১৯ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এক সাধারণ নাগরিকের হঠাৎ বিরাট আয় বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ ইডির হাতে তদন্তের ভার দেয়া এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে সিবিআইয়ের প্রস্তুতি নেয়ার ফলে তৃণমূল কংগ্রেস আরও গভীর ফ্যাসাদে পড়তে চলেছে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে।

বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাম ও তৃণমূল বুঝতে পারবে আর মানুষ দেখতে পাবে দাদা দিদির সেটিং কেমন হয়েছে। তৃণমূলের জেলে যাওয়ার হিড়িক লেগে যাবে। আরেক বিজেপি নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, আগামী দিনে বাংলায় যোগী আদিত্য সরকারের মতন বুলডোজার সরকার তৈরি হবে। তৃণমূলের বহু নেতা মন্ত্রী দুর্গাপূজা কাটাবে জেলে বসে। যদিও বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ধীরগতিতে কেন্দ্রীয় সংস্থা তৃণমূলের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে এটাই প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী সেটিং হয়েছে। আর কংগ্রেস নেতা তথা ভারতের লোকসভার বিরোধী দল নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, দিল্লীতে মোদী মমতা বৈঠকে সেটিং হয়ে থাকতে পারে ইডি সিবিআই যাতে তদন্তে চুড়ান্ত তৎপর না হয়। বিরোধী বাম কংগ্রেসের মোদী মমতা সেটিং তত্বে কার্যত সিলমোহর দিলেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল। সিবিআই নোটিসের পর নোটিস পাঠিয়ে যাচ্ছে আর তিনি বারবার তা এড়াচ্ছেন। নয়বার তলবের মধ্যে মাত্র একবারই সিবিআই দপ্তরে গিয়ে তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। বাকি সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনও সুযোগ পাননি কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। গরু পাচার কাণ্ডের তদন্তে মামলায় নবমবারের সিবিআই তলবেও গরহাজির রইলেন তিনি। সোমবার কলকাতায় এলেন, নিজাম প্যালেসের অদূরে এসএসকেএম হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করালেন। হাসপাতালে ভরতি হতে হল না তাকে। কিন্তু তারপরও সিবিআই দপ্তরে না গিয়ে সোজা বোলপুরে ফেরেন । তাহলে অনুব্রত মণ্ডলকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে এবার তবে কোন পথে হাঁটবে সিবিআই? এই প্রশ্ন উঠছে। গরু পাচার মামলার তদন্তে নিজাম প্যালেস থেকে সিবিআইয়ের তলব পেয়েই অনুব্রত মণ্ডল জানিয়েছিলেন, তার পক্ষে কলকাতায় গিয়ে হাজিরা দেওয়া সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা যদি বোলপুর গিয়ে জেরা করতে চান, তাহলে তিনি অবশ্যই সহযোগিতা করবেন। কিন্তু সিবিআই তাকে জানায়, কলকাতার নিজাম প্যালেসে হাজিরা দিতেই হবে।

কখনও অসুস্থতা, কখনও ভোটের কাজে ব্যস্ত থাকার দরুণ অনুব্রত দীর্ঘদিন সিবিআই দপ্তরে হাজিরা দেননি। মাঝে মাত্র একবারই তিনি আসেন নিজাম প্যালেসে। কিছুক্ষণের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য চলে যান এসএসকেএমে। সেখানে কিছুদিন ভরতি থাকার পর ছাড়া পেয়ে বোলপুরের বাড়িতে ফেরেন। এরপর ফের তাকে গরু পাচার মামলায় সোমবার (৮ আগস্ট) ডেকে পাঠান সিবিআই তদন্তকারীরা। কিন্তু তিনি ইমেইল মারফৎ সিবিআইয়ের কাছে আরও খানিকটা সময় চান। কারণ, সোমবারই তার এসএসকেএমে চেক আপের দিন ছিল। হাসপাতালে গেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সময় দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছিলেন। প্রয়োজনে মঙ্গলবার তিনি নিজাম প্যালেসে যেতে পারেন বলেও জানান। এরপর সিবিআইয়ের ইতিকর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কীভাবে অনুব্রত মণ্ডলকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এবার আরও চাপে পড়তে পারেন তৃণমূল নেতা। সরাসরি তাঁর বাড়ি গিয়ে জেরা করতে পারে সিবিআই। কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের নেতা-মন্ত্রীদের সম্পত্তি নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলায় ইডিকে পার্টি করার নির্দেশ দিল আদালত। জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে কোন পথে? এই প্রশ্ন তোলা হয় আবেদন। মামলাকারী বিপ্লব কুমার চৌধুরী ১৯ জন নেতা, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেন ২০১৭ সালে। হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে দায়ের হওয়া এই মামলার শুনানিতে সোমবার ইডিকে পার্টি করার নির্দেশ দেওয়া হল। পরবর্তী শুনানি আগামী সেপ্টেম্বর মাসে।

বিপ্লব কুমার চৌধুরীর নামে জনৈক ব্যক্তির দায়ের করা মামলার মূল বিষয় ছিল, ২০১১ সাল থেকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের সম্পত্তির হিসেবনিকেশ করে দেখা গিয়েছে, একেকজনের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে হাজার গুণ পর্যন্ত। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনী হলফনামায় সম্পত্তির যে পরিমাণ দেখানো হয়েছিল, পরবর্তী ৫ বছরের তা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কীভাবে এই বৃদ্ধি? এই প্রশ্ন তুলে ২০১৭ সালে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। আবেদনে নাম রয়েছে ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র, অমিত মিত্র, অর্জুন সিং, ব্রাত্য বসু-সহ একাধিক হেভিওয়েটের।

মামলাকারীর আবেদনে কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়াও তৃণমূলের ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের নাম রয়েছে। তালিকায় নাম প্রাক্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়, প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্য়ায় ও সাধন পাণ্ডেরও। যেহেতু বিষয়টি সম্পত্তি নিয়ে, তাই এই মামলায় এবার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে পার্টি করার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। সেই নির্দেশ মেনে মামলাকারী ইডিকে চিঠি পাঠাবেন। পরবর্তী শুনানিতে ইডি নিজের ভূমিকা স্পষ্ট করবে। খবর এমনই।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় ইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার ঘনিষ্ঠ মডেল অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। সেসব পার্থ ঘনিষ্ঠরাই তাঁর বাড়িতে রেখেছেন বলে দাবি ছিল অর্পিতার। এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির সঙ্গে মন্ত্রীর নাম জড়িয়েছে। তার তদন্তে রয়েছে ইডি। এবার অন্যান্য মন্ত্রী, নেতাদেরও সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় তদন্তের সুবিধার্থে উচ্চ আদালতের ইডিকে পার্টি করার নির্দেশ যথোপযুক্ত, মনে করছে আইনজ্ঞ মহল। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় দুর্নীতি-কাণ্ডে জেল হেফাজতে রয়েছেন। তৈরি হচ্ছে আরেক কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই। আদালতে নিজেদের হেপাজতের নিতে আবেদন করবে সংস্থাটি। করবে তদন্ত। অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে টাকার পাহাড়। বহু সোনাদানা, গয়নাগাটি ও একাধিক সম্পত্তি। শুধু কলকাতা নয়, বাংলার বিভিন্ন জেলায় জেলায় সম্পত্তি রয়েছে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের। তারপরই তৃণমূলের আরও ১৯ জনকে স্ক্যানারে রেখেছে ইডি। এখন ১৯ জনকে জেরা শুরু হলে তৃণমূল সরকার পড়ে যাবে প্রবল চাপে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাই অগ্নিপরীক্ষায় সামনে মমতার ‘সততার প্রতীক’ ট্যাগ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App