×

জাতীয়

ভাড়া নিয়ে দিনভর নৈরাজ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২২, ০৮:২১ এএম

ভাড়া নিয়ে দিনভর নৈরাজ্য

ফাইল ছবি

** ৪০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে ** যাত্রীরা ক্ষুব্ধ-হতাশ ** সড়কে তৎপর বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত **

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বর্ধিত ভাড়া কার্যকরের প্রথমদিনে সব গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা। এই বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের চলছে তর্ক-বিতর্ক, এমনকি পরিস্থিতি হাতাহাতি পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। গতকাল রবিবারও সড়কে বাস কম চলাচলের কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তবে সড়কে বাস ভাড়ার নৈরাজ্য প্রতিরোধে বিআরটিএর একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত সকাল থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে তৎপরতা শুরু করেছে।

তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ মানতে নারাজ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত হারেই ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ গণপরিবহনের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত নতুন ভাড়া সব পরিবহন কোম্পানিকে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী পরিবহনগুলো ভাড়া আদায় করছে। এখানে হাতাহাতি বা তর্ক-বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।

একই ধরনের কথা বলেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব ওসমান আলী। তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত ও ভাড়ার হার আমরা শ্রমিকদের জানিয়ে দিয়েছি। যদি কোনো পরিবহনের লোকজন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

এদিকে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের কথার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। গতকাল সকাল থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হওয়ার পর বাসগুলোতে এখনো বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট টাঙানো হয়নি। তাছাড়া যাত্রীরাও এলাকা ভেদে দূরত্ব জানেন না। এই অবস্থায় পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। চালক ও কন্ট্রাক্টর যেই টাকা ভাড়া দাবি করছে যাত্রীদের ওই পরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মিডলাইন পরিবহনের যাত্রী আনিসুর রহমান। এ নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। আনিসুর রহমানের অভিযোগ, প্রতি কিলোমিটার ৩৫ পয়সা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু বাসের কন্ট্রাক্টররা কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীরা গন্তব্যের দূরত্ব না জানায় এবং পরিবহনের কর্মীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দূরত্ব ধরে ভাড়া আদায়ের কারণে যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। যাত্রীদের পকেট কাটা যাচ্ছে। উত্তরা থেকে মালীবাগের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। এই দূরত্বে ৫ টাকার মতে ভাড়া বাড়ার কথা। কিন্তু ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি ভাড়া চাওয়া হচ্ছে। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেই তর্কবিতর্ক এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে।

এদিকে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণার পর এখনো রাজধানীর রাস্তায় সব বাস রাস্তায় নামেনি। এ কারণে এখনো গণপরিবহনের সংকট কাটেনি। উপায় না পেয়ে যাত্রীরা পরিবহন কর্মীদের চাহিদা মতো ভাড়া দিয়েই গন্তব্য ছুটছেন। কোনো কোনো রুটের বাস কিলোমিটার প্রতি এক টাকার বেশি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। বিআরটিএ এখনো নতুন ভাড়ার চার্ট পরিবহনগুলোকে সরবরাহ করেনি।

বাসচালক আহমেদ জানান, এখনো বিআরটিএর ভাড়ার তালিকা তাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। তাই আগের ভাড়ার আন্দাজের ওপর দূরত্ব ধরে কন্ট্রাক্টর যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। তালিকা পাওয়ার পর সরকারের নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হবে।

বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত : সড়কে বাস ভাড়ার নৈরাজ্য প্রতিরোধে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তৎপরতা শুরু করে। যাত্রীদের অভিযোগের পর বেশ কিছু বাসকে জরিমানাও করা হয়। শনিবার ভাড়া বাড়ানোর পর বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, সরকারের নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তদারকি থাকবে। সকাল থেকে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত মহাখালী বাস টার্মিনালে তৎপরতা চালায়। এ সময় বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফিরোজা পারভীনের নেতৃত্বে বিআরটিএর একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে অবস্থান নেয়। এই সড়কে চলাচলরত যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন ম্যাজিস্ট্রেট। যাত্রীদের অভিযোগ পাওয়ার পর কয়েকটি বাসকে জরিমানা করা হয়। বেশির ভাগ বাসচালক ও কন্ট্রাক্টরকে সতর্ক করে দেয়া হয়।

দূরপাল্লার বাস ভাড়ায়ও নৈরাজ্য : মহানগরীতে বাস ভাড়া নৈরাজ্যের পাশাপাশি দূরপাল্লার পরিবহনেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। টার্মিনালগুলোর সব কাউন্টারেই যাত্রীদের কাছ থেকে টিকেট প্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। গাবতলী বাস টার্মিনালে হানিফ এন্টারপ্রাইজ ঢাকা-কুড়িগ্রাম ভাড়া ৮০০ টাকার স্থলে ১ হাজার টাকা নিয়েছে। রংপুরের ভাড়া ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকায় টিকেট বিক্রি করছে। অন্য পরিবহন কোম্পানিগুলোও একইভাবে ভাড়া আদায় করে। যশোরের ৫৫০ টাকার ভাড়া ৬৫০ টাকা, বরিশালের এসি বাসের ৬০০ টাকার ভাড়া ৭০০ টাকা, যশোরের ভাড়া ৫৫০ টাকার স্থলে ৬৫০ টাকা নেয়া হয়েছে।

রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পরিবহন কোম্পানির কাউন্টারগুলোতে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হয়। শ্যামলী পরিবহনের ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের নন-এসি বাসের টিকেটের দাম ৬৫০ টাকা। এর আগে এই টিকেটের দাম ছিল ৫৮০ টাকা। এসি বাসের টিকেটের দাম ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০০ করা হয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রুটের নন-এসি বাসের ভাড়া ৯০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৩০০ রাখা হয়। ঢাকা-সিলেটের নন-এসি বাসের ভাড়া ৫৭০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ৭০০ থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। শ্যামলী কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা সোহরাব জানান, তারা টিকেট প্রতি ৬০-৭০ টাকা বাড়িয়েছেন। বিআরটিএর চার্ট পাওয়ার পর সরকার নির্ধারিত ভাড়া নেয়া হবে। হানিফ এন্টারপ্রাইজের নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম নন-এসি বাসের ৫৮০ টাকার ভাড়া ৭০০ টাকা, কক্সবাজারের ৯০০ টাকার ভাড়া ১ হাজার টাকা এবং সিলেটের ৫৭০ টাকার ভাড়া ৭০০ টাকা নেয়া হয়।

তবে সৌদিয়া পরিবহন, মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের জলসিঁড়ি, অনন্যা ও অনন্যা ক্লাসিক পরিবহন কোম্পানি গতকালও আগের ভাড়াতেই যাত্রী পরিবহন করে। সরকার ২২ শতাংশ ভাড়া বাড়ালেও সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা হাতে না পাওয়ায় এই পরিবহনগুলো আগের ভাড়াতেই যাত্রী পরিবহন করছে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার মাস্টার কাওসার।

প্রজ্ঞাপন জারি : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নিধারণ করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, পুনঃনিধারিত এই ভাড়া গ্যাসচালিত মোটরযানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। নতুন ভাড়ার তালিকা সব বাস ও মিনিবাসের দৃশ্যমান স্থানে আবশ্যিকভাবে টাঙিয়ে রাখতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App