×

জাতীয়

জীবনযাত্রায় চাপ বাড়বে, সর্বত্র ক্ষোভ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২২, ০৮:০৩ এএম

জীবনযাত্রায় চাপ বাড়বে, সর্বত্র ক্ষোভ

ফাইল ছবি

অসহনীয় হবে মূল্যস্ফীতি > উত্তাপ ছড়াবে নিত্যপণ্যের বাজার > ব্যাহত হবে শিল্প উৎপাদন > বেড়ে গেল কৃষকের উৎপাদন ব্যয় > খরচ বাড়বে আমদানি-রপ্তানির

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় রাতারাতি পাল্টে গেল বাংলাদেশের পুরো চিত্র। শুক্রবার মধ্যরাতে এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশের পর দেশজুড়ে জীবনযাত্রার সব সূচকে ব্যয় বেড়ে গেছে। আচমকা এই চাপে পড়ে দেশের মানুষ দিশাহারা। তার প্রতিফলন ঘটেছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে। উত্তেজিত জনতা এমনকি পুলিশের গাড়িও ভাঙচুর করেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থতি বিবেচনায় অনেকটা বাধ্য হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেছেন, জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে খাদ্য, কৃষি, যোগাযোগ, চিকিৎসা, পড়াশোনাসহ সবকিছুতেই নাজেহাল সাধারণ মানুষ। দাম বাড়ানোর সংবাদ আসার পর পরই রাস্তায় কমে যায় গণপরিবহন। আর যেসব পরিবহন চলাচল করেছে- তারা মানুষের কাছ থেকে নিয়েছে তিন গুণ-চার গুণ বেশি ভাড়া। এমন বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় এক বৈঠকে বাস ও লঞ্চের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে বিআরটিএ। পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় এখন পণ্য পরিবহনের খরচও বাড়বে। যার খেসারত দিতে হবে ভোক্তাদের। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসা পণ্যের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে। আর ভোক্তাকে বাড়তি দামেই তা কিনতে হবে। শুধু পণ্য পরিবহন খরচ নয়, দাম বাড়ার কারণে বাড়বে কৃষকের উৎপাদন খরচও। ইতোমধ্যে সরকার ইউরিয়া সারের দাম প্রতি কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন করে ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ দিতে আগের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হবে কৃষককে। ইতোমধ্যে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, জ্বালানির দাম বাড়াতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্বালানির দাম বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত ছয় মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির হার সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অধিকাংশ পণ্যের দাম কয়েক দফা বেড়ে গেছে। নতুন করে জ্বালানির দাম বাড়ায় আরো অসহনীয় হয়ে উঠবে বাজার পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা আয় না বাড়লেও ব্যয়ের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে সীমিত আয়ের মানুষ পড়বেন চরম বিপাকে।

খরচ বাড়বে আমদানি-রপ্তানির : গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, পরবর্তী সময়ে গ্যাসের দাম। একবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর দ্বিতীয় দফায় অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে পরিবহন খরচ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এছাড়া লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানাগুলোতে সম্প্রতি ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে। তাই উৎপাদন খরচও বেড়েছে। আগামীতে বৈশ্বিক মন্দা হওয়ার আভাস মিলছে। ক্রেতারা আগের মতো দাম দিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ক্রয়াদেশ বাতিলও করে দিচ্ছে। এছাড়া জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি হবে লাগামহীন। শ্রমিকরা তখন বেতন বাড়ানোর দাবি করবে। সব মিলে চরম সংকটে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর কার্যকরী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের কাগজকে বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণে চরম ক্ষতিগ্রস্ত আমরা। ইতোমধ্যে পরিবহন খরচ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। জ¦ালানির দাম বাড়ার বিরূপ প্রভাবে মূল্যস্ফীতি হবে লাগামহীন। আর মূল্যস্ফীতি বাড়লে শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করবে। সব মিলে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা। সামনে বৈশ্বিক মন্দার আভাস রয়েছে। আসলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বলা বড় মুশকিল।

বাড়বে জীবন যাত্রার ব্যয়, বাড়বে মূল্যস্ফীতি : জ্বালানির দাম বাড়ার বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ে জনজীবনে। জ্বালানির অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যয় আগের তুলনায় দ্বিগুণও হতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করেন বিশেজ্ঞরা। দেশের বেসরকারি খাতের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোর হিসাবে সর্বোচ্চ। এটা সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বাড়াবে বলে আশঙ্কা করা যায়। মূলত, ডিজেলের ব্যবহারে যে খাতগুলোতে বেশি ব্যয় হয়- যেমন : পরিবহন, কৃষি খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাত- এসব ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে ভোক্তার ওপর পণ্যের দাম বাড়ার চাপ আসবে। আমার মনে হয় এই চাপ সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে যাচ্ছে। কৃষি খাতে শুষ্ক মৌসুমে ডিজেলের মাধ্যমে সেচের ব্যবহারের ওপরও প্রতিক্রিয়া পড়বে। ফলে শাকসবজিসহ কৃষিপণ্যে দাম বাড়বে। এছাড়া ডিজেল ব্যবহার বন্ধের কারণে বিদ্যুৎ কমেছে। হয়তো এখনই এর প্রতিক্রিয়া থাকবে না। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে ডিজেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য বিষয়ে একটা প্রতিক্রিয়া থাকবে। আর সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

প্রতিবাদ ও ক্ষোভ সারাদেশে : ছুটির দিনে গভীর রাতে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ সারাদেশে অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও সরকারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।

বেড়ে গেল কৃষকের উৎপাদন খরচ : দুদিন আগেই বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম। প্রতি কেজি সারের দাম ৬ টাকা বাড়িয়ে ডিলারদের জন্য ২০ টাকা আর খুচরা পর্যায়ে ২২ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। কৃষকের অন্যতম এই পণ্যে ভর্তুকি দিয়ে আসত সরকার। দফায় দফায় বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে চোখে অন্ধকার দেখছেন কৃষকরা। নতুন করে ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে। কারণ, হিসেবে তারা বলছেন, সারের দাম বাড়ার পর ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে খরচ দ্বিগুণ বাড়বে বলেও মনে করেন তারা।

উত্তাপ ছড়াবে নিত্যপণ্যের বাজার : চাল, ডাল আলু থেকে থেকে শুরু করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। এসব পণ্যের দাম দ্রুত বাড়লেও কমার নজির খুবই কম। বাড়তে বাড়তে নিত্যপণ্যের বাজার ইতোমধ্যে চূড়ায় পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে ডলারের অস্থিরতার কারণে আমদানিনির্ভর পণ্যের বাজার খুবই চড়া। এছাড়া মাত্র দুদিন আগে চালের দাম পাইকারি পর্যায়ে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর আগে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে প্রায় ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছিল সরকার। যদিও পরবর্তী সময়ে কিছুটা কমেছে, তবে বাড়ার তুলনায় তা অর্ধেকেরও কম। এবার নতুন করে জ¦ালানির দাম বাড়ার বিরূপ প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের বাজারে। পণ্য পরিবহন খরচ ও উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে বাড়বে খরচও। যার মাশুল দেবেন ভোক্তারা। সব মিলে দাম বাড়ার কারণে আরো বেশি ভুগতে হবে ভোক্তাকে।

মাশুল দিচ্ছেন ভোক্তারা : জ্বালানির দাম বাড়ার চড়া মাশুল দিচ্ছেন ভোক্তারা। পণ্য ক্রয় থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ভুগতে হচ্ছে তাদের। বাস ও লঞ্চ ভাড়া বেশি হলে যেমন তাদের খরচ বেড়ে যায়; তেমনি চাল, ডালসহ ভোগ্যপণ্য কিনতেও বাড়তিহ খরচ খরচ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। সংসারের খরচ আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, জ¦ালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো হয়েছে। এর আগে একবারে এত দাম বাড়ানো হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে জ¦ালানির দাম বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু বহুমাত্রিক। কারণ, এর প্রভাব সবক্ষেত্রে পড়ে। এতে চরম সংকটে পড়বেন ভোক্তারা। আয় না বাড়লেও ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। দাম বাড়ানোর বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এর জন্য বেশি ভুগতে হবে সীমিত আয়ের মানুষকে। নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার জ¦ালানি খাতের দুর্নীতি কমিয়ে এনে কিছুটা সমন্বয় করতে পারত। কিন্তু এই পথে না গিয়ে অস্বাভাবিকহারে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে কোনোভাবেই যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে না।

যা বলছে এফবিসিসিআই : এফসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গতকাল শনিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বড় ধাক্কা আসবে অর্থনীতিতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্য না বাড়িয়ে সরকার চাইলে ধাপে ধাপে দাম বাড়াতে পারত। এত বেশি দাম বাড়ানোর কারণে কৃষি থেকে শুরু করে পরিবহন ও যাতায়াতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। সর্বোপরি সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হবে। আর চলমান পরিস্থিতিতে তেলের দাম বাড়ানো খুবই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। দেখা যাবে মধ্যম মানের ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়ছেন। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ইতোমধ্যে রপ্তানিতে তিন মাসের একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমরা কী পরিস্থিতিতে আছি এটা বোঝাতে হলে ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে আমি মারা গেছি’। যখন চাহিদা কম থাকে তখন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দাম কমানোর বিষয়ে একটা চাপ সৃষ্টি করে। এখন চাহিদা কমে গেছে, ক্রেতারা চাপ সৃষ্টি করবে দাম কমানোর জন্য। তাই এখন কারখানা টিকিয়ে রাখার জন্য কম দামের পণ্য তৈরি করতে হবে। জ¦ালানির দাম বাড়ানোর কারণে ব্যবসা আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলেও মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার রাত ১০টায় ঘোষণা আসে ১২টার পর থেকে জ্বালানি তেলের নতুন দাম কার্যকর করা হবে। এ ক্ষেত্রে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়। এত দিন কেরোসিন ও ডিজেল প্রতি লিটার ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা প্রতি লিটার আর পেট্রোল ৮৬ টাকা প্রতি লিটারে বিক্রি হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App